কপোতাক্ষ নদ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

কপোতাক্ষ নদ (Kapotaksha Nod) – মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutta) কবিতাটি ৯ম-১০ম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য বইয়ের একটি অধ্যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত “কপোতাক্ষ নদ” অধ্যায় এর লেখক পরিচিতি, গল্প, কবিতা, শব্দার্থ ও টীকা, পাঠ পরিচিতি, অনুশীলনী, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেওয়া হলো।

কপোতাক্ষ নদ

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে !

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে ! 

বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, 

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে? 

দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে।

আর কি হে হবে দেখা? – যত দিন যাবে, 

প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে 

বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে 

বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখা-রীতে

নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে 

লইছে যে তব নাম বঙ্গের সংগীতে।

কবি-পরিচিতি

মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলজীবনের শেষে তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে অধ্যয়নকালে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগ জন্মে। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। তখন তাঁর নামের প্রথমে যোগ হয় ‘মাইকেল’। পাশ্চাত্য জীবনযাপনের প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তীব্র আবেগ তাঁকে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। পরবর্তীকালে জীবনের বিচিত্র কষ্টকর অভিজ্ঞতায় তাঁর এই ভুল ভেঙেছিল। বাংলা ভাষায় কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর কবিপ্রতিভার যথার্থ স্ফূর্তি ঘটে। তাঁর অমর কীর্তি ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ: তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য ও চতুর্দশপদী কবিতাবলি। তাঁর নাটক : কৃষ্ণকুমারী, শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী; এবং প্রহসন : একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ এবং সনেট প্রবর্তন করে তিনি যোগ করেছেন নতুন মাত্রা । ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জুন কবি পরলোকগমন করেন ।

শব্দার্থ ও টীকা

সতত– সর্বদা।

বিরলে– একান্ত নিরিবিলিতে।

নিশা– রাত্রি।

ভ্রান্তি– ভুল।

বারি-রূপকর– প্রজা যেমন রাজাকে কর বা রাজস্ব দেয়, তেমনি কপোতাক্ষ নদও সাগরকে জলরূপ কর বা রাজস্ব দিচ্ছে।

চতুর্দশপদী কবিতা– ইংরেজিতে Sonnet, বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা।

চৌদ্দ-চরণ– সমন্বিত ভাবসংহত সুনির্দিষ্ট। চতুর্দশপদী কবিতার প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক (Octave) এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষষ্টক (Sestet) বলে। অষ্টকে মূলত ভাবের প্রবর্তনা এবং ষষ্টকে ভাবের পরিণতি থাকে। চতুর্দশপদী কবিতায় কয়েক প্রকার অন্ত্যমিল প্রচলিত আছে। যেমন, প্রথম আট চরণ: কখখক কখখক। শেষ ছয় চরণ: ঘঙচ ঘণ্ডচ। অথবা প্রথম আর্ট চরণ: কখখগ কখখগ, শেষ ছয় চরণ: ঘঙঘঙ চচ। ‘কপোতাক্ষ নদ’ একটি চতুর্দশপদী কবিতা। এখানে মিলবিন্যাস: কখখকখক  থকথকথগথগবগব ।

পাঠপরিচিতি

‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি কবির চতুর্দশপদী কবিতাবলি থেকে গৃহীত হয়েছে। এই কবিতায় কবির স্মৃতিকাতরতার আবরণে তাঁর অত্যুজ্জ্বল দেশপ্রেম প্রকাশিত হয়েছে। কবি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে মধুসূদন এই নদের তীরে প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছেন। যখন তিনি ফ্রান্সে বসবাস করেন, তখন জন্মভূমির শৈশব-কৈশোরের বেদনা-বিধুর স্মৃতি তাঁর মনে জাগিয়েছে কাতরতা। দূরে বসেও তিনি যেন কপোতাক্ষ নদের কলকল ধ্বনি শুনতে পান। কত দেশে কত নদ-নদী তিনি দেখেছেন, কিন্তু জন্মভূমির এই নদ যেন মায়ের স্নেহডোরে তাঁকে বেঁধেছে, কিছুতেই তিনি তাকে ভুলতে পারেন না। কবির মনে সন্দেহ জাগে, আর কি তিনি এই নদের দেখা পাবেন ! কপোতাক্ষ নদের কাছে তাঁর সবিনয় মিনতি-বন্ধুভাবে তাকে তিনি স্নেহাদরে যেমন স্মরণ করেন, কপোতাক্ষও যেন একই প্রেমভাবে তাঁকে সস্নেহে স্মরণ করে । কপোতাক্ষ নদ যেন তার স্বদেশের জন্য হৃদয়ের কাতরতা বঙ্গবাসীদের নিকট ব্যক্ত করে।

অনুশীলনী কর্ম

১। তোমার নিকটবর্তী নদী বা খাল সম্পর্কে ২০০ শব্দের মধ্যে একটি রচনা লেখ।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১। ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি রচনাকালে কবি কোন দেশে ছিলেন?

ক. ফ্রান্সে

খ. ইংল্যান্ডে

গ. ইতালিতে

ঘ. আমেরিকায়

২। ‘কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে’? এ উক্তিতে কবির কোন ভাব প্রকাশ পেয়েছে ?

i. মমতা

ii. অনুরাগ

iii. ভ্ৰান্তি

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i ও ii

খ. i ও iii

গ. ii ও iii

ঘ. i, ii ও iii

উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও :

প্রবাস জীবনে ফাস্টফুডের দোকানে

কত খাবার খেয়েছি আমি জীবনে।

মায়ের হাতের পিঠার কথা

ভুলি আমি কেমনে ?

৩। ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার কোন বিষয়টি উদ্দীপকটিতে প্রকাশ পেয়েছে?

ক. সুখস্মৃতির অনুপম চিত্রায়ন

খ. রঙিন কল্পনার নিদর্শন

গ. কষ্টকর স্মৃতির কাতরতা

ঘ. স্নেহাদরের কাতরতা

৪। অনুচ্ছেদটির মূল বক্তব্য নিচের কোন চরণে ফুটে উঠেছে?

ক. সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।

খ. জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।

গ. এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ?

ঘ. আর কি হে হবে দেখা ।

সৃজনশীল প্রশ্ন

ছোটকালে ছিলাম বাঙালিদের বালুচরে,

সাঁতরায়ে নদী পাড়ি দিতাম বারবার এপার হতে ওপারে,

ডিভি লটারি সুযোগ করে দিলে ছুটে চলে যাই আমেরিকায়

কিন্তু আজ মন শুধু ছটফটায় আর শয়নে স্বপনে বাড়ি দিয়ে যায়, 

মধুময় স্মৃতিগুলো আমাকে কাঁদায়, তবু দেশে আর নাহি ফেরা হয় ।

ক. সনেটের ষষ্টকে কী থাকে ?

খ. ‘স্নেহের তৃষ্ণা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

গ. উদ্দীপকে প্রতিফলিত অনুভূতি ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার আলোকে তুলে ধর।

ঘ. ‘উদ্দীপকে প্রতিফলিত অনুভূতির অন্তরালে যে ভাবটি প্রকাশ পেয়েছে তা-ই কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার মূলভাব’- কথাটির সত্যতা বিচার কর ।

More From ৯ম ১০ম শ্রেণীর বাংলা সহপাঠ বই