হাম্দ্ – সৈয়দ আলাওল

হাম্দ্ (Hamd) – সৈয়দ আলাওল (Syed Alaol) কবিতাটি ৯ম-১০ম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য বইয়ের একটি অধ্যায়। সৈয়দ আলাওল রচিত “হাম্দ্” অধ্যায় এর লেখক পরিচিতি, গল্প, কবিতা, শব্দার্থ ও টীকা, পাঠ পরিচিতি, অনুশীলনী, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেওয়া হলো।

হাম্দ্

আলাওল

বিছমিল্লা প্রভুর নাম আরম্ভ প্রথম ।

 আদ্যমূল শির সেই শোভিত উত্তম ॥

প্রথমে প্রণাম করি এক করতার ।

যেই প্রভু জীবদানে স্থাপিল সংসার ॥

করিল প্রথম আদি জ্যোতির প্রকাশ।

তার প্রীতি প্রকটিল সেই কবিলাস ॥

সৃজিলেক আগুন পবন জল ক্ষিতি ।

নানা রঙ্গ সৃজিলেক করি নানা ভাঁতি ॥

সৃজিল পাতাল মহী স্বৰ্গ নর্ক আর ।

স্থানে স্থানে নানা বস্তু করিল প্রচার ॥

সৃজিলেক সপ্ত মহী এ সপ্ত ব্ৰহ্মাণ্ড

চতুর্দশ ভুবন সৃজিল খণ্ড খণ্ড ॥

সৃজিলেক দিবাকর শশী দিবারাতি।

সৃজিলের নক্ষত্ৰ নিৰ্মল পাঁতিপাঁতিঃ

সৃজিলেক শীত গ্রীষ্ম রৌদ্র ছায়া আর।

করিল মেঘের মাঝে বিদ্যুৎ সঞ্চার ॥

সৃজিল সমুদ্র মেরু জলচরকুল।

সৃজিল সিপিতে মুক্তা রত্ন বহু মূল ॥

সৃজিলেক বন তরু ফল নানা স্বাদ ৷

সৃজিলেক নানা রোগ নানান ঔষদ ॥

 সৃজিয়া মানব-রূপ করিল মহৎ।

 অন্ন আদি নানাবিধ দিয়াছে ভুগত ॥

 সৃজিলেক নৃপত্তি তৃঞ্জয় সুখে রাজ

হস্তী অশ্ব নর আদি দিছে তারে সাজ ॥

সৃজিলেক নানা দ্রব্য এ ভোগ বিলাস ।

কাকে কৈল ঈশ্বর কাকে কৈল দাস ॥

 কাকে কৈল সুখ ভোগে সতত আনন্দ ৷

কেহ দুঃখী উপবাসী চিন্তাযুক্ত ধন্ধ ॥

আপনা প্রচার হেতু সৃজিল জীবন।

 নিজ ভয় দর্শাইতে সৃজিল মরণ ॥

 কাকে কৈল ভিক্ষুক কাকে কৈল ধনী

কাকে কৈল নির্গুণী, কাকে কৈল গুণী ॥

কবি পরিচিতি

সৈয়দ আলাওল আনুমানিক ১৬০৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার ফতেয়াবাদের অন্তর্গত জোবরা গ্রামে, মতান্তরে ফরিদপুরের ফতেয়াবাদ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিশ কুতুবের অমাত্য। জলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় আলাওলও তাঁর পিতা পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন। যুদ্ধে পিতা নিহত হলে আলাওল পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে পড়ে আরাকানে নীত হন। সেখানে তিনি আরাকানরাজ সাদ উমাদারের দেহরক্ষী অশ্বারোহী সেনাদলে চাকরি লাভ করেন। রাজমন্ত্রী মাগন ঠাকুর তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি ও প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তিনি সপ্তদশ শতকের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত। তিনি আরবি, ফারসি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। এছাড়া তিনি রাগসংগীত, যোগ ও ভেষজ শাস্ত্র, সুফিতত্ত্ব ও বৈষ্ণব সাধনা ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। আলাওলের যেসব গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলো হলো : পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, হপ্তপয়কর, সেকান্দরনামা, তোহফা ইত্যাদি। এ ছাড়া তিনি কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রাণী র শেষাংশ রচনা করেন। আলাওলের কাব্য অনুবাদমূলক হলেও তা মৌলিকতার দাবিদার। আলাওল আনুমানিক ১৬৭৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন ।

শব্দার্থ ও টীকা

হাম্দ্– সাধারণ অর্থ : প্রশংসা, বিশেষ অর্থ : আল্লাহর প্রশংসা।

বিছমিল্লা– আল্লাহর নামে শুরু করা, কোনো কাজ শুরু করার আগে মুসলমানেরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলেন। পূর্ণ বাক্যটি হলো : বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। অর্থ : আমি পরম দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি।

করতার– কর্তা, প্রভু।

প্রকটিল– প্রকাশ করল।

কবিলাস– কৈলাস বা স্বৰ্গ।

ক্ষিতি– মাটি।

সপ্ত মহী– সাত স্তর বিশিষ্ট পৃথিবী।

নক– নরক ।

সপ্ত ব্রহ্মাণ্ড– সাত স্তর বিশিষ্ট আকাশ।

চতুর্দশ ভুবন– পৃথিবীর সাত স্তর এবং আকাশের সাত স্তর মিলে চতুর্দশ ভুবন।

দিবাকর– সূর্য।

শশী– চাঁদ।

পাঁতিপাঁতি– পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে।

সিপিতে– ঝিনুকে।

ভুঞ্জয়– ভাগ করে।

ভাঁতি– শোভা, ভুগত- ভোগ করতে, দর্শাইতে- দেখাতে।

পাঠ-পরিচিতি

হামদ’ কবিতাংশটি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এটি ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের প্রারম্ভে মহান আল্লাহর প্রশংসাসূচক পর্বের অংশ।

কবি এই কবিতাংশে বিশ্বসৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। কবি মহান স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর সৃষ্টির মহিমা বর্ণনা করেছেন। আগুন, বাতাস, পানি ও মাটি এসব উপাদান সহযোগে আল্লাহ এই বিশাল বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তারপর জলচরপ্রাণী, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষলতা,পশুপাখি এবং সব শেষে সৃষ্টি করেছেন মানুষ। স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানুষের উপভোগের জন্য বিচিত্র উপকরণ প্রদান করা হয়েছে। বিধাতা মানুষকে ভাগ্যের অধীন করে পার্থিব জীবনে সুখী কিংবা দুঃখী, গুণী কিংবা নির্গুণ করে পাঠিয়েছেন।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

হাম্দ্‌’ কবিতার আলোকে প্রভু জীবের জন্য প্রথমে কী সৃষ্টি করেছেন?

ক. জ্যোতি

খ. ক্ষিতি

গ. শশী

ঘ. মহী

হাম্দ্’ কবিতায় কবি আলাওল-এর মতে, স্রষ্টার জীব সৃষ্টির কারণ কী?

ক. আনন্দ লাভ

খ. সক্ষমতা প্রকাশ

গ. আনুগত্য লাভ

ঘ. স্রষ্টার আত্মপ্রকাশ

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে নং প্রশ্নের উত্তর দাও।

তারকা রবি শশী খেলনা তব হে উদাসী

পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি।

৩। উদ্দীপকটি ‘হাম্প্” কবিতার কোন ভাবের সাথে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ?

ক. স্রষ্টার লীলা

খ. সৃষ্টিসম্ভার

গ. সৃস্টিরহস্য

ঘ. স্রষ্টার খেয়াল

৪। সঙ্গতিপূর্ণ দিকটি ফুটে উঠেছে যে চরণে-

i. সৃজিলেক সপ্ত মহী এ সপ্ত ব্রহ্মাণ্ড

ii. সৃজিল সিপিতে মুক্তা রত্ন বহু মূল

iii. সৃজিলেক আগুন পবন জল ক্ষিতি

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii

গ.ii ও iii

খ. i ও iii

ঘ.i, ii ও iii

সৃজনশীল প্রশ্ন

এই সুন্দর ফুল, এই সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি

খোদা, তোমার মেহেরবানি

এই শস্য শ্যামল ফসল ভরা

মাঠের ডালি খানি

খোদা, তোমার মেহেরবানি।

ক. ‘হাম্দ্’ কবিতায় প্রথমে কাকে প্রণাম করার কথা বলা হয়েছে?

খ. ‘কাকে কৈল ঈশ্বর, কাকে কৈল দাস – এ চরণে কবি কী বুঝিয়েছেন?

গ. কবিতাংশটিতে ‘হাম্দ্’ কবিতার যে বিশেষ দিকের প্রতিফলন ঘটেছে তা ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. উদ্দীপকে মূল চেতনা প্রকাশ পেলেও ‘হাম্দ্’ কবিতায় কবি আলাওল স্রষ্টার সৃষ্টির বৈচিত্র্য আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছেন- মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর।

More From ৯ম ১০ম শ্রেণীর বাংলা সহপাঠ বই