বন্দনা – শাহ মুহম্মদ সগীর

বন্দনা (Bondona) – শাহ মুহম্মদ সগীর (Shah Muhammad Saghir) কবিতাটি ৯ম-১০ম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য বইয়ের একটি অধ্যায়। শাহ মুহম্মদ সগীর রচিত “বন্দনা” অধ্যায় এর লেখক পরিচিতি, গল্প, কবিতা, শব্দার্থ ও টীকা, পাঠ পরিচিতি, অনুশীলনী, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেওয়া হলো।

বন্দনা

শাহ মুহম্মদ সগীর

দ্বিতীয়ে প্রণাম করো মাও বাপ পাত্ৰ ৷

যান দয়া হন্তে জন্ম হৈল বসুধায়

পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত ।

 কোন্ দিআ বুক দিআ জগতে বিদিত ॥

 অশক্য আছিল মুই দুৰ্বল ছাবাল।

তান দয়া হস্তে হৈল এ ধড় বিশাল ॥

না খাই খাওয়াএ পিতা না পরি পরাএ ৷

 কত দুক্ষে একে একে বছর গোঞাএ ॥

 পিতাক নেহায় জিউ জীবন যৌবন ।

 কনে না সুধিব তান ধারক কাহন

ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড় ।

 দোসর-জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার ॥

 আহ্মা পুরবাসী আছ জথ পৌরজন ।

 ইষ্ট মিত্র আদি জথ সভাসদগণ ।

তান সভান পদে মোহার বহুল ভকতি।

সপুটে প্রণাম রোহার মনোরথ গতি ॥

 মুহম্মদ সগীর হীন বহোঁ পাপ ভার ।

 সভানক পদে দোয়া মাগো বার বার

 

কবি-পরিচিতি

শাহ মুহম্মদ সগীর আনুমানিক ১৪-১৫ শতকের কবি। মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনিই প্রাচীনতম। তিনি গৌড়ের সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৩-১৪০৯ খ্রিষ্টাব্দ) ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি পঞ্চদশ শতকের প্রথম দশকে রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। কাব্যের রাজবন্দনায় ‘মহামতি গেছে’ বলে যাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ বলে অনুমিত। কবির শাহ উপাধি থেকে অনুমান করা হয় যে, তিনি কোনো দরবেশ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার কাব্যে চট্টগ্রাম আঞ্চলের কতিপয় শব্দের ব্যবহার লক্ষ করে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক তাঁকে চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে বিবেচনা করেছেন। কাব্যের রাজবন্দনায় ‘মুহম্মদ সগীর তান আজ্ঞার অধীন’-এ কথা থেকে ধারণা করা হয় যে, তিনি হয়তো সুলতানের কর্মচারী ছিলেন কিংবা কাব্যচর্চায় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যে দেশী ভাষায় ধর্মীয় উপাখ্যান বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন, তবে কাব্যে ধর্মীয় পটভূমি থাকলেও তা হয়ে উঠেছে মানবিক প্রেমোপাখ্যান। তাঁর কাব্যের শিল্পমূল্য অতুলনীয়।

শব্দার্থ ও টীকা

পুরাবাসী- নগরবাসী।

বন্দনা- স্তুতি, প্রশংসা।

করো- করি। যান- যার।

হস্তে- হতে, থেকে।

থুইলা- রাখল।

অশক্য- অশক্ত, দুর্বল।

আছিহুঁ- ছিলাম।

মুই- আমি।

ছাবাল- ছাওয়াল, ছেলে, সন্তান।

তান- তাঁর।

গোঙাও- গুজরান করে, অতিবাহিত করে।

পিতাক- পিতাকে।

নেহায়- স্নেহে।

বিদিত- জানা।

মনোরথ- ইচ্ছা, অভিলাষ।

জিউ- আয়ু জীবিত থাকা।

কনে- কখনও।

ধারক- ধারের, ঋণের।

কাহন– ষোলপণ, টাকা।

বাড়– বাড়া, বেশি।

দোসর- দ্বিতীয়।

মোহার- আমার।

সপুটে– করজোড়ে।

সভান- সবার।

সভানক- সবার।

বসুধায়- পৃথিবীতে।

তিঁহ– তিনিও।

আহ্মার- আমার।

বিদিত- জানা।

মনোরথ- ইচ্ছা, অভিলাষ।

পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না ধুইলা মাটিত- মায়ের স্নেহ মমতার তুলনা নেই। মায়ের সদাজাগ্ৰত কল্যাণদৃষ্টি সন্তানের জীবনপথের পাথেয় স্বরূপ।

শিশুকে মা বহু যত্নে লালন- পালন করেন।

পিঁপড়ার ভয়ে মা সন্তানকে মাটিতে রাখে নি- এই কথা উল্লেখ করে কবি মায়ের সেই স্নেহ মমতা ও কল্যাণ দৃষ্টিকেই বড় করে তুলেছেন।

অশক্য আছিলঁ মুই দুর্বল ছাবাল- এখানে কবি মানব শিশুর শৈশবকালীন অসহায় অবস্থার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

মায়ের আদর- যত্ন ও পরিচর্যা লাভ করে শিশু ধীরে ধীরে পরিণত মানুষ হয়ে উঠে। কবি তাঁর স্নেহময়ী মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এই পঙ্ক্তিটি ব্যবহার করেছেন।

পাঠ-পরিচিতি

শাহ মুহম্মদ সগীরের “ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যের বন্দনা পর্ব থেকে গৃহীত এই কবিতাংশ ‘বন্দনা’ নামে সংকলিত হয়েছে। ‘বন্দনা’ পর্ব যথেষ্ট বড়, এখানে শুধু গুরুজনদের প্রতি বন্দনার অংশটুকু স্থান পেয়েছে। কবি তাঁর মূল কাব্যের প্রারম্ভে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রশংসা করেছেন। সংকলিত এই কবিতাংশে জন্মদাতা পিতামাতার ও জ্ঞানদাতা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। পিতামাতা অশেষ দুঃখকষ্ট স্বীকার করে পরম যত্নে সন্তানকে বড় করে তোলেন। শিক্ষক জ্ঞানদান করে তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই তাঁদের প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। কবি তাঁর কাব্য রচনায় সাফল্য লাভের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেছেন।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

কীসের ভয়ে মা সন্তানকে মাটিতে রাখেননি?

ক. ঠাণ্ডা

খ. পিঁপড়া

গ. পোকা

ঘ. মশক

‘না খাই খাওয়াএ পিতা- এ চরণে প্রকাশ পেয়েছে –

i. অপত্যস্নেহ

ii. সন্তান বাৎসল্য

iii. উদারতা

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii

খ. i ও iii

গ. ii ওiii

ঘ.  i, ii, iii

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও

অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার লাভ করে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। হাজারো কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ছুটে যান শৈশবের বিদ্যাপীঠে, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তাঁর দীক্ষাগুরুদের যাঁদের কাছে তিনি হাতেখড়ি নিয়েছিলেন।

৩। উদ্দীপকের অমর্ত্য সেন – এর মাঝে ‘বন্দনা’ কবিতার কোন দিকটি ফুটে উঠেছে?

ক. স্মৃতিকাতরতা

খ. স্বদেশপ্রেম

গ. গুরুভক্তি

ঘ. স্বজাত্যবোধ

8। তাঁর এ হেন অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে নিচের কোন চরণে?

ক. ইষ্ট মিত্র আদি জথ সভাসদগণ।

খ. দোসর জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার।

গ. যান দয়া হন্তে জন্ম হৈল বসুধায়।

ঘ. কোল দিআ বুক দিআ জগতে বিদিত।

সৃজনশীল প্রশ্ন

১। বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর মা এক রাতে পানি খেতে চান। ঘরে পানি না থাকায় তা বাহির থেকে সংগ্রহ করে ফিরে এসে দেখেন মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। পানির পাত্র হাতে জিলানী সারা রাত মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকেন, যাতে ঘুম থেকে জাগলেই মাকে পানি দিতে পারেন। মা যেন পিপাসায় কষ্ট না পান

ক. ‘বন্দনা’ কবিতায় পিতার চেয়েও কাকে বেশি শ্রদ্ধা দেখাতে বলা হয়েছে?

খ. ‘দোসর জন্ম’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে?

গ. উদ্দীপকের জিলানীর মাঝে ‘বন্দনা’ কবিতার যে দিক প্রকাশ পেয়েছে তা ব্যাখ্যা কর।

ঘ. প্রকাশিত দিকটিই ‘বন্দনা’ কবিতার একমাত্র দিক নয়- মন্তব্যটির পক্ষে তোমার যুক্তি দাও।

More From ৯ম ১০ম শ্রেণীর বাংলা সহপাঠ বই