কাকতাড়ুয়া – সেলিনা হোসেন

কাকতাড়ুয়া (Kaktarua) – সেলিনা হোসেন (Selina Hossain) উপন্যাসটি ৯ম-১০ম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য বইয়ের একটি অধ্যায়। সেলিনা হোসেন রচিত “কাকতাড়ুয়া” অধ্যায় এর লেখক পরিচিতি, গল্প, উপন্যাস, শব্দার্থ ও টীকা, পাঠ পরিচিতি, অনুশীলনী, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেওয়া হলো।

কাকতাড়ুয়া

রাত পােহালে দিনের আলাে, সুয্যি ডুবলে আঁধার। ওর কাছে দুটোই সমান। হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে যে কোথায় যায় সে হিসেব রাখে না। ওর কাছে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সব সমান। মনে করে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই ওর জন্য রাস্তা খােলা। 
 
পথ ওকে ডাকে আয়। ও হেসে বলে, এই তাে এসেছি। দেখ আমাকে। 
 
পথ ওকে দেখে। মাঠ-ঘাট ওকে দেখে। ও মনের আনন্দে দুপায়ে পথের ধুলাে মাখে। কিসে যে ওর আনন্দ, কিসে কান্না, কেউ বুঝতে পারে না। 
 
ও বােঝে অনেক। সবার মাথার ওপর দিয়ে ওর দৃষ্টি ছুটে যায়! ও তাকিয়ে বলে, দেখ আমাকে সবাই ওকে দেখে। ওকে দেখা কারও ফুরােয় না। ও এমনই। এই দিনযাপনে ওর কোনাে কষ্ট নেই। 
 
ঘুমুর জায়গা নেই তাে কী হয়েছে? দোকানের বারান্দা আছে; গাছতলা আছে, হাটের চালা আছে, ঘাটে বাঁধা নৌকা আছে। নৌকার ছইয়ের ভেতর দিব্যি ঘুমিয়ে থাকা যায়। আর সেসব কিছু না পেলে গেরস্ত বাড়ির কাছারির বারান্দা আছে। আছে দরজাবিহীন ভেঁকিঘর। টুক করে ঢুকে পড়ে গুটিসুটি শুয়ে থাকা যায়। গেরস্তের উঠোনে খড়ের গাদা আছে। খড় বিছিয়ে শুয়ে পড়লে কেউ দেখতে পায় না। অনেক রাতে ঘুম ভাঙলে মাথার ওপরে তারাভরা আকাশটা দেখতে পায়। পাশ ফিরে শােয়ার সময় টের পায় নেড়ি কুকুরটা খড়ের ওমে গা ডুবিয়ে ওর পাশে শুয়ে আছে। ওকে নড়তে দেখে আলতাে করে গা চেটে দেয়। ভালােই লাগে ওর। ও আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। এমনই রাত কাটে ওর। রাত নিয়ে ওর কোনাে ঝামেলা নেই। 
 
সব বেলার ভাত নেই তাে কী হয়েছে? ফলপাকুড় আছে, নদীর পানি আছে। নােক বুয়ার মুড়ি ভাজা আছে। চায়ের দোকানে কাজ করে দিলে চা-বিস্কুট জোটে। ওটুকু খেয়ে রাত কাৰার করে দিতে পারে। তা ছাড়া কখনাে-সখনাে গেরস্ত বাড়িতে ছােট-খাটো কাজের ডাক পড়ে। তখন অড়হর ডালের সঙ্গে ভাত জোটে। নইলে কেউ সুন-পান্তা দেয়। কারও বাড়িতে চালের আটার রুটির সঙ্গে একটুখানি ঝােল পাওয়া যায়। বিয়েবাড়ি হলে ভাত-মাংস পায় পেটপুরে। ওর দিন চলে যায়। এসব নিয়ে ওর কোনাে মন খারাপ নেই। 
 
ও ভয় পায় না। ভয় ওকে কাবু করে না। আসলে ভয় কী, তা ও জানেই না। ও ছােটবেলায় ভূতের গল্প শােনেনি। কেউ ওকে জুজুর ভয় দেখায়নি। ও তাে নিজের নিয়মে বড় হয়েছে। যে ছেলে নিজের নিয়মে বড় হয় ভয়ের সঙ্গে তার দেখা হয় না। ভয় আড়ালেই থেকে যায়। তাই ছেলেটি চারদিকে খােল চোখে তাকাতে পারে। কোনাে ভয়েই ওকে চোখ বুজে ফেলতে হয় না। ভীষণ সাহস ওর। 
 
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছিস, বুধা? 
 
সােনার ঘরে। 
 
সেটা কী? 
 
ও হাত উল্টে পা বাড়ায়। এই প্রশ্নের জবাব ও কাউকে দেয় না। যার ঘর নেই তার চারদিকে তাে সােনার ঘরই থাকে। এটা কি বলে দিতে হবে? মাঝে মাঝে লােকজন এমন বােকার মতাে প্রশ্ন করে, দেখে ওর হাসি পায়। হাসতে হাসতে নিজেকে বলে, মানুষের বােকামির সীমা নেই। ও তাইরে নাইরে করতে করতে পথে হাঁটে। গান গায়। গানে বুক উজাড় করে দেয়। গান ওর ভীষণ প্রিয়। আখড়ার গান শুনে ও গাল শেখে! একবার শুনলেই গাইতে পারে। ওর মনে হয়, যার ভেতরে গান থাকে সে অনেক কিছু করতে পারে। সে একটা ভালাে মানুষ হয়। এসব ভাবতে ভাবতে ও পথের ধারে বসে পড়ে। ওর পায়ের কাছে মরা শামুকের খােল পাড়ে থাকে। ও বুড়াে আঙুলের মাথায় সেটা তুলে নিয়ে নাচাতে থাকে। নাচাতে নাচাতে ও ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। ওর পা উঠে থাকে আকাশের দিকে। ও হাত দিয়ে বােদ আড়াল করে। ভাবে, এমন মজার খেলা বুঝি আর হয় না । ও হাতের ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় শামুকের খােলটা ওর বুড়াে আঙুলে টুপির মতাে লাগছে। লােহার টুপি। বুড়াে আঙুলটা যদি একটা মানুষ হয়, তা হলে খােলটা মানুষের মাথায় একটি অন্যরকম টুপি। মানুষটা বুঝি যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়েছে। ছেলেটা এমন ভাবনায় নিজের চারপাশ ভরিয়ে তােলে।
 
ওর দিন এভাবে চলে। কারও খেতে কামলা খাটে, কারও গরু চরায়, কারও মােট বয়। জেলে নৌকায় মাছ ধরে। মুদির দোকানে বসে কেনাবেচা করে। চায়ের দোকানে চা বানায়। খদ্দেরের সামনে চায়ের কাপ নিয়ে যায় । ধানখেতে নিড়ানি দেয়। আরও কত কী! ওর কাজের শেষ নেই। 
 
গাঁয়ের লােকে বলে, ও পাগল হয়নি। শক্ত হয়ে গেছে। জমে শক্ত হয়ে যাওয়া যাকে বলে। 
 
চোখের সামনে মা-বাবা, চার ভাই-বােনকে মরে যেতে দেখলে কেউ কি নরম থাকে? নাকি থাকতে পারে? তার জীবনটা তাে আর স্বাভাবিক নিয়মে চলে না। চলার উপায় থাকে না। কলজে খুবলে খায় শকুন । ও দুঃখকে হিংস্র শকুনই ভাবে। এসব ভাবলে ও মগজের ভেতরে শুনতে পায় শকুনের পাখা ঝাপটানি। শকুনের শক্ত চপুর ঠোকরানাের শব্দ। ওর সামনে জেগে ওঠে একটি ভয়াবহ কুটিল রাত। 
 
কী রকম ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল সে রাতে। নিস্তব্ধ গ্রাম। মাঝে মাঝে ভেসে আসে কুকুরের কান্না। মনে হয় কেউ যেন সে শব্দ দিয়ে বিনুনি গাঁথছে। সেই শব্দের বিনুনি পেঁচিয়ে রাখে বুকের চারপাশ। হঠাৎ করে কোনাে বাড়িতে কান্নার রােল উঠলে ওর মনে হয় আকাশ ফুটো হয়ে একটা কঠিন বজ্রপাত ঘটে যাচ্ছে একের পর এক। ঘরের ভেতরে ওর বাবার শরীর মােচড়াতে থাকে। মােচড়াতে মােচড়াতে স্থির হয়ে যায় চোখের মণি। ঘরে একটিমাত্র কুপি। ফুরিয়ে আসছে তেল। ঘরে কেরােসিন নেই যে কুপিতে আর একটু তেল দেওয়া যাবে। কিংবা কুপিতে তেল দিতে হবে, পাশের ঘরে চাচির কাছে গিয়ে তেল চেয়ে আনতে হবে, এমন কিছু চিন্তা ও করতে পারেনি। তখন তাে এসব ভাবনার সময় ছিল না। ও দেখতে পায় একপাশে পড়ে আছে মা। তার বুকে ছােট তিনু। তিনুর বয়স দেড় বছর। 
 
কাটির মতাে শরীর। বােঝা যাচ্ছে না যে ও বেঁচে আছে কি না। ও তিনুর গায়ে হাত দিয়ে শিউরে ওঠে। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে শরীর। ওর বুকটা ধক করে ওঠে। তিনু ওর কোলে উঠতে খুব ভালােবাসত! ওকে দেখলেই দুহাত বাড়িয়ে আ-আ শব্দ করত। ও ওকে বুকে নিয়ে উঠোনে নেমে যেত। ঘুমপাড়ানি গান গাইত। ওর কাঁধে মাথা রেখে এখন ও কী করবে? তিমুর জন্যে কি একটা গান গাইবে? গান শুনে কি জেগে উঠবে তিমু? ওর কোলে ওঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে? ছেলেটির বুক খালি হয়ে যায়। দেখতে পায় ঘরের অন্য পাশে মেঝেতে গড়াচ্ছে শিলু আর তালেব। ওর ঘােট দুজনে। দুজনে পিঠাপিঠি। ওদের সঙ্গেই তাে ছেলেটির খেলাধুলাে, ঘুরে বেড়ানাে ছিল। 
 
কখনাে ফলপাকুড় ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া বেধে যেত। কত দিন দুজনকে দু-চার ঘা লাগিয়েছে, সে কথা মনে করে বুক ফেটে যায় ওর। পরক্ষণে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও দেখতে পায় ছােট ভাইবােন দুটো একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর শেষ। রাত পােহানাের আগে বিনুও চলে যায়। মাত্র কয়েক ঘন্টা, অথচ ওর জীবনের আকাশ-পাতাল উথাল করা সময়। বিনু ওর পিঠাপিঠি বােন। কত স্মৃতি ওর সঙ্গে। এত কিছু ও ভুলবে কী করে? সেই বিনু আর নেই। বিনুটার চোখ বুজে গেছে। আর কখনাে ওই চোখজোড়া খুলবে না। অপূর্ব ছিল বিনুর চোখ। যেন পুরাে একটা বিল ঢুকে আছে ওর চোখে। বিনু হাসলে মনে হতাে বিলের জলে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। ওর সামনে পুরা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। 
 
একসময় রাত পােহায়। সকাল হতে ও ঠাণ্ডা নিপ্রাণ শরীরগুলাে হাত দিয়ে দেখে সব জমে শক্ত হয়ে গেছে। ও বুঝে যায়, জমে শক্ত হয়ে যাওয়া মানে মৃত্যু। ও কাঁদতে পারে না। নিজেকে আছড়াতে পারে না। অনুভব করতে থাকে। ওর পায়ের নিচ থেকে শক্ত হয়ে যেতে শুরু করেছে। সে বােধ ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকে। প্রথমে পায়ের পাতা। তারপর হাঁটু, উরু, কোমর, পেট, বুক, পিঠ, গলা, নাক, চোখ, কপাল এবং চুল শক্ত হয়ে গেছে। ও পাথরের চোখ মেলে মৃত্যু দেখে। সেবার কলেরায় মহামারিতে উজাড় হয়ে যায় গাঁয়ের অর্ধেক লােক। মাঝে মাঝে নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে, কীভাবে বেঁচে গেলাম। সেই মৃত্যু এবং অন্ধকার রাতের কথা মনে করলে ওর আর কোনো ভয় থাকে না। বুঝতে পারে না গাঁয়ের লােকে ওকে পাগল বলে কেন, আসলে ও তাে একটি সাহসী বালক হয়েছে। 
 
ও মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুহাত দুপাশে সােজা করে জামাটা মাথায় বেঁধে কাকতাড়ুয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখতে পায় কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায় বােলতা। বোঁ করে একটা শব্দের তরঙ্গ উঠে মুহূর্তে মিলিয়ে যায় বাতাসে। ওর মনে হয় ওটা বােলতার ডাক নয়, শব্দটা ওর চাচির কণ্ঠ। চাচি ওকে সকালে মরিচ পুড়িয়ে পান্তাভাত খেতে দিয়ে বলছে, রােজ রােজ কেবল ভাত গেলা। ঢ্যাঙা তাে কম হসনি। কামাই করতে পারিস না,বাপু? কামাই। 
 
ভাত খেতে খেতে ও শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। শক্ত হয়ে থাকা মগজের গায়ে শব্দটা ঠোক্কর খায়। 
 
তাের মা-বাপ তাে মরে খালাস। এখন জ্বালা আমার। পরের ছেলের বােঝা টানতে পারি না,বাপু? 
 
বােঝা। শব্দটা ওর শক্ত হয়ে থাকা বুকের মাটিতে বলের মতাে লাফায়। ও ভাবতে থাকে। 
 
শােন বুধা, তুই তাে দেখতেই পাস যে তাের চাচার রােজগার নেই। তাের আটজন চাচাতো ভাইবোেন, দিন চলে না। ও নীরবে ভাত খায়। পােড়া মরিচ ডলে ডলে ভাত লাল করে ফেলেছে। আশ্চর্য, ঝালে ওর জিব পুড়ছে না। কেমন অদ্ভুত স্বাদ হয়ে ভাতের লাল দলা গলা দিয়ে নামছে। শুধু ওর চোখে পানি আসতে চায়। কিন্তু সে পানিও বাধা পায়। গড়ায় না। 
 
চাচি খানিকটা ধমকের সুরে বলে, কি রে কথা বলছিস না যে? 
আমি কামাই করব। 
চাচির চোখ উজ্জ্বল হয়। 
সত্যি কামাই করবি? 
নিজের বােঝা নিজে বইব। 
সত্যি ? 
তাহলে তুই আমাকে মুক্তি দিবি? 
হ্যা, সত্যি। 
 
মুক্তি। শব্দটি শুনে ও হোঁচট খায়। গলায় ভাত আটকে গেলে ও জোরে জোরে কাশতে থাকে। চাচি ওকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। 
 
পানি খা, বাপু। এত অল্পে কেন যে হাের চোখ লাল হয়ে যায়। ছােটবেলায় তুই খুব লক্ষ্মী ছেলে ছিলি। একদম মায়ের নেওটা। এক রাতে মানুষগুলাে মরে যাওয়ার পর তুই যে কেমন হয়ে গেলি! কিছু হলেই তোর চোখ লাল হয়ে যায়। 
 
সত্যি আমার চোখ লাল হয়ে যায়? 
হ্যা রে, সত্যি। একটুও মিছে বলছি না। 
আমি ভেবেছিলাম আমার চোখটা পাথরের চোখ হয়ে গেছে। কিছু দেখতে পাই না, চাচি। 
 
রে না, সে যে কেমন লাল আমি তােক বােঝাতে পারব না। তখন তােকে দেখলে আমার সালাম করতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, তুই আমার মুরব্বি। হয় আমার বাবা, না হয় চাচা।
 
কেন যে আমাকে লজ্জা দেন চাচি। 
তােক লজ্জা দিতে চাই না রে। আমার কি সাধ্য যে– 
ওর চাচি কথা শেষ করতে পারে না! আঁচলে চোখ মােছে। তারপর রান্নাঘরের দরজায় বসে গুনগুনিয়ে কাঁদে। 
 
চাচির কান্না ছেলেটি শুনতে পায় না। সেদিকে ওর খেয়াল নেই। চাচির কথা শুনে ছেলেটি ভীষণ খুশি হয়। মনে হয়, নিজেই সেই বােলতাটার মতাে শব্দ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। বাসনের বাকি ভাতটুকু ধীরেসুস্থে শেষ করে। বুঝে যায় ওর কোনাে ভয় নেই। ও কতবার এমন করে নিজেকে আবিষ্কার করবে? কতবার নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারবে যে ওর ভয় নেই? আজ ওর ভারি আনন্দের দিন। লাল চোখের কথা ভাবতে ভাবতে ও একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ও আর কখনাে ওই বাড়িতে থাকার জন্য ফিরে যায়নি। গিয়েছে চাচির সঙ্গে দেখা করতে। কখনো ছােট ভাইবােনগুলােকে ফুলপাকুড়ের ভাগ দিতে গিয়েছে। বারান্দায় বসে দুদণ্ড গালগল্প করেছে। চাচি আঁচল দিয়ে ওর মুখের ঘাম মুছিয়ে দিয়েছে। বােনেরা পানি দিয়েছে। গুড়-মুড়ি দিয়েছে। ও কখনাে খেয়েছে, কখনাে খায় নি। শুধু ওর মনে হয়েছে এ গেলেই কুত্তির চোখ ছলছল করত। ও একটি কথাও বলত না। চুপচাপ বসে থাকত। অপলক তাকিয়ে থাকত। ওই বাড়িতে গেলেই ওর বুক ভার হয়ে যেত। ও ওর শক্ত হয়ে যাওয়া বুকের বােঝা আর বাড়াতে চাইত না। 
 
যেদিন ও চাচির বাড়ি থেকে একবারের জন্য বেরিয়ে এলাে সেদিন ভেবেছিল, সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার মানে কি মুক্তি? সম্পর্ক কি ভাঙা যায়? ছেলেটি উত্তর পায় না। বুঝতে পারে না সম্পর্ক কী? বাবা মরে গেলে কি চাচি পর হয়ে যায়? অথচ চাচাতাে বােন ছােট্ট কুক্তি সম্পর্কের অধিকার নিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরে কাদতে কাদতে ওর পিছে পিছে এসেছিল। বলেছিল, তুমি যেয়াে না, বুধা ভাই। ও কুন্তির কথায় ফিরে তাকায়! কুন্তির কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর শুনে ওর চোখ থেকে লাল আভা মুছে যায়। ও বুঝতে পারে ওর বুকের ভেতরটায় জখম হয়েছে। ক্ষত থেকে রক্ত পড়ছে। আশ্চর্য, সম্পর্ক কী এমন? কুন্তি না হয়ে আর কেউ হলে ও কি এমন কষ্ট পেত? কুন্তি ওর হাত ধরে বলেছিল, তুমি যেয়াে না, বুধা ভাই। 
যাব না। 
হ্যাঁ,যেয়াে না। 
কেন? 
তুমি চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে। খারাপ লাগবে? 
কেন? 
কুক্তির কণ্ঠস্বর এক মুহূর্তে যেন বদলে যায়। ওর মনে হয় এই কণ্ঠস্বর ওর কাছে নতুন আবিষ্কার। ও কুন্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আজ যাই। আর একদিন আসব।। 
কবে আসবে? 
গায়েই তাে থাকব। যখন মন চাইবে তখন আসব। 
এটা কি আসা হলাে? 
এটা আসা হলাে না? 
একটুও ভালাে আসা না। ভালাে আসা কী, আমি তাে জানি না, কুন্তি। তারপর খুশি হয়ে বলে, ঠিক আছে আমি একদিন ভীষণ ভালােভাবে আসব। 
কবে? 
খুশিতে কুন্তির দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কবে,আসবে বুধা ভাই? 
তাের বিয়ের সময়। 
বিয়ে? আমার তাে বিয়ে হবে না। বড় বুয়াদেরই তাে বিয়ে হয়নি। আমাকে কে বিয়ে করবে? 
করবে, করবে। দেখবি লাল টুকটুকে বর আসবে। 
তােমার মতো? 
‘ধুৎ বােকা। আমার মতাে হবে কেন? আমি কি একটা ছেলে হলাম? আমি তাে এখন পথের ছেলে। এতিম । অনেক সুন্দর, অনেক ভালাে বর পাবি তুই। 
 
কুস্তির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়ায়। ও কাঁদতে কাঁদতে বলে, তােমার মতাে কেউ ভালো নয়। বুধা বলে, আমি যাই রে, কুন্তি । তুই বাড়ি যা। চাচি দেখলে তােকে বকবে। আমি চাই না আমার জন্য তােকে বকা খেতে হােক। কুন্তি পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদে। ছেলেটি পেছনে তাকায় না। ওর মনে হতে থাকে, কুন্তি যেন চিৎকার করে বলছে, তােমার মতো কেউ ভালাে নয়। ও বুঝতে পারে না। ও যদি এতই ভালাে হবে,তৰে চাচি কেন ওকে সইতে পারল না? তা হলে সম্পর্কটা কি এমন যে কারও কাছে ভাললা, কারও কাছে খারাপ? ভাবতে ভাবতে ও মাঠের মাঝখানে কাকতাড়ুয়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এটা ওর খেলা। এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকেই ও মানুষের আদর পেতে চায়। এই খেলা খেলতে খেলতেই ও বড় হতে চায়। ও দেখে কাঠফাটা রােদে দাঁড়িয়ে থাকলে একসময় ওর মাখার ওপর শকুনের ছায়া নেমে আসে। ওকে দেখলে শকুনের বুঝি মনে হয় মরা মানুষ। তালগাছের ওপর থেকে সাঁই করে উড়ে আসে। আসলে কাকডয়ার ভেতরে ও গাঁয়ের বেশির ভাগ মানুষকে দেখতে পায়। ওরা এমনই কাকতাড়ুয়া। ছন্নছাড়া। পথেঘাটের, হাটবাজারে। বাড়ি নেই। পেটভরা ভাত নেই। শুধু গায়ের কয়েকজন মানুষ শকুনের মতাে। কাকতাড়ুয়া ওদের ভয়ে তটস্থ থাকে। 
 
গাঁয়ের লােকে ওর নাম দিয়েছে কাকতাড়ুয়া। নােক বুয়া ডাকে ছন্নছাড়া। হরিকাকুর জালে প্রচুর মাছ উঠলে ওর দিকে তাকিয়ে ফোকলা গালে হেসে বলে, মানিকরতন। পাকা ধান কাটার সময় জয়নাল চাচা ওকে বাবা ছাড়া কথা বলে না। বলে, সােলাবাবা। হাটের দিনে ভালাভরা বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হাশেম মিয়া বলে, ও খােকনবাবু, আজ তুই আমার বাড়িতে ভাত খাৰি। লােকটা বেশি সওদা করতে পারলে আত্মহারা হয়ে যেত। গাঁয়ের গােবর কুড়ানি বুড়িটা ওকে গোবররাজা বলে ডাকে। অনেক দিন ও বুড়িকে গােবর কুড়িয়ে দিয়েছে। ওর তাে অনেক নাম । এতে ও ভীষণ খুশি। 
 
ওর মনে হয় ভালােই তাে। যার যা খুশি সে নামেই আমাকে ডাকুক। একজনের অনেক রকম নাম থাকলে সেসব নামের ভেতর দিয়ে অনেক রকম মানুষ হতে পারে। ও অনেক রকম মানুষ হতে চায়। কেন? যেমন, কুন্তির ভাবনার মতাে ভালাে। নােক বুয়ার ভাবনার মতাে সাহসী। চাচির কথার মতাে লাল চোখের মানুষ। ভরা মাছের জাল টেনে তুললে হরিকাকুর দুচোখের বিস্ময়ে লেখা হয় একটি শব্দ, শক্তিশালী। আর কী? বিশ্বাসী? হ্যা। পরােপকারী? হঁ্যা। সহৃদয়? হ্যা। বন্ধুত্বসুলভ? হ্যা। আর কী। সবকিছু, সবকিছু। ও ভাবতে ভাবতে ছুট দেয়। মাঠ পেরিয়ে, ঘাট পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে ছুটতে থাকে। ওর কল্পনায় ভেসে ওঠে তেপান্তরের মাঠ, পঙ্খিরাজ ঘােড়া, সাত সমুদ্র তেরাে নদী। 
 
এভাবে ওর দিন ভালােই কাটছে। চাচির প্রতি ও কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। ভাবে, চাচি ওকে মুক্তির কথা বলে স্বাধীন মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দিয়েছে। কী মজা স্বাধীন মানুষ, স্বাধীন মানুষ। ও স্বাধীন মানুষ বলতে বলতে বাজারে এলে হাবু দোকানদার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, কী বলছিস রে, বুধা? 
স্বাধীনতা। 
স্বাধীনতা? দূর বােকা। 
ছেলেটি ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, স্বাধীনতা ভীষণ আনন্দের। স্বাধীনতা খুব দরকার। আমি তাে এখন স্বাধীন মানুষ। দোকানদার নিজের কাজে মন দিতে দিতে বলে, ছেলেটার পাগলামি গেল না। একদিন ও কাকতাড়ুয়া খেলার সময় দেখতে পায় গাঁয়ে মিলিটারি এসেছে। ও আগেই শুনেছে দেশে যুদ্ধ লেগেছে। মিলিটারি শহর-গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। কিন্তু মিলিটারি কেমন—তেমন কোনাে ধারণা ওর ছিল না। থাকবেই বা কী করে। এর আগে গায়ে তাে কখনাে মিলিটারি আসেনি। এসেছে পুলিশ। পুলিশ দেখে ওর ভয় লাগেনি । উল্টো পুলিশ গাঁয়ের রবি চোরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ওরা অনেক ছেলেমেয়ে ওদের পিছে পিছে থানা পর্যন্ত গিয়েছিল। হল্লা করে যেতে সেবার ওর বেশ মজাই লেগেছিল। 
 
কিন্তু এবার মিলিটারি আসে জিপে করে। গুলি ছুড়তে ছুড়তে। বুটের শব্দ যেন চড়চড় শব্দে ফুটছিল। যেন যেখানে পা পড়ছে সেই মাটি ফেটে চৌচির হয়ে ফুটছে। ও দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বড় সড়কের মাঝ বরাবর মিলিটারির জিপ থেকে ওরা ঝপঝপিয়ে নামে। ও ওদের বাজারের দিকে ছুটে যেতে দেখে। ও ধানগাছের আড়ালে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। একটু পর পর মাথা ওঠায়। কোন দিকে গেল লােকগুলাে? পরক্ষণে ভেসে আসে। আর্তনাদ। একটু পর বাজারের চালাগুলাে দাউদাউ পুড়তে থাকে। ও আতঙ্কে ধানখেতের কাদায় মিশে যায়। অবাক কাণ্ড। ও বুঝতে পারে ওর মাথার মধ্য দিয়ে দ্রুত অনেক কিছু পার হয়ে যাচ্ছে। মিলিটারি চলে গেলে ও ছুটে বাজারের সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ কেউ হয় আগুনে পুড়ে, নয় গুলি খেয়ে মরেছে। অনেকে মারা যায়নি, কিন্তু আহত হয়েছে। যারা বেঁচে আছে তারা ছােটাছুটি করে আগুন নেভানাের চেষ্টা করছে। ও নিজেও একটা মাটির হাঁড়ি নিয়ে ডােবা থেকে পানি আনে। পানি আনতে আনতে ওর রাগ বাড়তে থাকে। ও মনে মনে ফুসতে থাকে। প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ওর বুকের ভেতর চুপচাপ শব্দ তােলে। একসময় আগুন নিভে গেলে আধা-পােড়া বাজারটার দিকে তাকিয়ে ওর চোখ লাল হতে থাকে। 
 
একজন ওকে বলে, কী হয়েছে, বুধা? 
কিছু না। 
আগুনের ধোঁয়ায় তাের চোখ লাল হয়ে গেছে। 
আমার কিছু হয়নি। 
আমার সঙ্গে চল। আমার বাড়িতে থাকবি। 
না। আমি এই বাজারে থাকৰ আধা-পােড়া ঘরের ছাদের নিচে আমি ঘুমাতে পারব। 
লােকটি হাঁ করে থেকে মুখ ভেঙচিয়ে বলে, তুই মানুষ হবি না।। 
 
মানুষ হব না, মানুষ হব না, মানুষ হব না বলতে বলতে ও আবার ছুটে যায়। ওর বুকের ভেতরে ভীষণ কিছু গজিয়ে উঠলে ও নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। কান পেতে নদীর কুলকুল ধ্বনি শােনে। জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে ওর দৃষ্টি জমাট হয়ে যায়। 
 
পরদিন গাঁয়ের অনেক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকে। ও প্রথমে নােক বুয়ার কাছে ছুটে যায়। গিয়ে তাে চক্ষু চড়কগাছ। নােলক বুয়ার বাঁধাছাদা শেষ। কোথায় গেল তার মুড়ি ভাজার সরঞ্জাম। খ্যাংরা কাঠির ছড়া উঠোনে গড়ায়। মাটির হাঁড়ি উল্টে পড়ে ভেঙে আছে। মুড়ির টিনগুলাে ঘরের চালায় ঝুলছে। বোেনাের আগে নােলক বুয়া ওকে জড়িয়ে ধরে। 
 
ছন্নছাড়া, আমার সঙ্গে চল । 
কোথায়? 
যেদিকে দুচোখ যায়। কোথাও না কোথাও একটা আশ্রয় তাে জুটবে। 
কিন্তু কেন যাব? 
নােলক বুয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার মােটাসােটা শরীরটা নড়ে না। প্রবল বিস্ময়ে বলে, এখন কি জিজ্ঞেস করার সময়? প্রশ্ন করছিস যে? দেখলি না কত কী ঘটে গেল? ওরা তাে আবার আসবে। তখন যাকে পাবে তাকে মারবে। আমরা কেউ বাঁচব না।
 
সবাই গেলে গাঁয়ে কে থাকবে? 
 
শােনাে ছেলের কথা! এখন কি এত কথা বলার সময় আছে? তাের হয়েছে কী বল তাে? বাপ-মা, ভাইবােন সব তাে গেছে। এখন কি ভাের নিজের যাওয়ার শখ হয়েছে? 
 
ও নােলক বুয়ার সঙ্গে কথা বলে না। নােলক বুয়া ওর কথার উত্তর দেয়নি। নােলক বুয়া কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। ও নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। ও তাে জানে, কেউ না থাকলে ও একাই থাকবে। কেন পালাবে? যে পালায় সে ভীতু। বােকা। সবার তাে উচিত গাঁয়ে থেকে লড়াই করা। লড়াই লড়াই বলতে বলতে ও হাঁটতে শুরু করে। অনেকে তখন পথে নেমেছে। ও সবার সঙ্গে কথা বলতে পারে না। কারণ, তারা ওর দিকে তাকানাের সময় পায় না। ওরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ভয়ে, আতঙ্কে ওরা পালাচ্ছে। বড় জামগাছটার নিচে দেখা হয় হরিকাকুর সঙ্গে। বেচারা লটবহরের বােঝায় কাহিল। হরিকাকুর জন্য ওর ভীষণ মায়া হয়। কত দিন ধরে কাকিমা অসুস্থ। ঠিকমতাে হাঁটতেই পারছে না। কাকিমা ওকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে । 
 
দেখ তাে মানিকরতন, এই বয়সে কেউ কি বাড়িঘর ছেড়ে বেরােতে পারে? 
 
কেঁদো না, কাকি। পালাও। তােমাদের বাঁচতে হবে তাে। তুমি তাে লড়াই করতে পারবে না। শুধু শুধু ওদের হাতে মরবে কেন? তােমার বােঝ আমাকে দাও, কাকু। আমি তােমাকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসি। 
 
এগিয়ে দিবি কেন? মানিকরতন, তুই আমার সঙ্গে চল। তােকে গায়ে রেখে যেতে আমার মন চায় না রে। 
 
তােমার সঙ্গে আমি কেন যাব? গায়ে থাকবে কে? তােমার ভিটে দেখবে কে? চলাে, তােমাকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেলা বাড়লে রােদে তােমাদের কষ্ট হবে। আমি তাে চাই যে তােমাদের যেন কষ্ট না হয়। হরিকাকু ওর মাথায় বােঝা দিয়ে সােজা হয়ে হাঁটে। বড় সড়কের ধারে এসে বলে, এবার তুই যা। এখন আমি পারব। ফিরে এসে তাের সঙ্গে আমার দেখা হবে তাে, মানিকরতন? 
 
হবে গাে, হবে । ভাবছ কেন? 
 
ছেলেটি হরিকাকুর চলে যাওয়া দেখে । কত বয়স হলাে কাকুর? হেঁটে যেতে পারবে তাে? নাকি পথের ধারে মরে পড়ে থাকবে? তখন কে ওকে মানিকরতন ডাকবে? ওর চোখ ভিজে ওঠে। 
 
ফেরার পথে দেখা হয় রানির সঙ্গে। ওদের পুরাে পরিবার চলে যাচ্ছে। রানি ভয়জড়ানাে কণ্ঠে বলে, যাচ্ছি রে, কাকতাড়ুয়া। 
 
যা, ফিরে এলে দেখা হবে। ঠিকমতাে যাস। ভয় পাস না। 
 
তুই কিন্তু আর কাকতাড়ুয়া খেলা খেলিস নে। মিলিটারি গুলি করতে পারে। দুষ্টুমি করিস না, কাকতাড়ুয়া। তােকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয় হয় । তুই যে কী ঘটিয়ে ফেলবি কে জানে! 
 
আমাকে নিয়ে তাের এত ভাবতে হবে না। তুই তাের পথে যা। তুই তো একটা ভীতুর ডিম। সে জন্য পালাচ্ছিস। আমি পালাৰ না। লড়াই করব। 
 
লড়াই করবি? 
 
হ্যা, লড়াই, লড়াই। যা, যা ভাগ। 
 
রানি দুচোখে বিস্ময় ছড়িয়ে বলে, ইস কত বাহাদুর, যেন বীরলড়াই করবে? সেদিনের ছোড়া, ঢঙ কত। 
 
ও আর কথা না বলে হাসতে হাসতে পা বাড়ায়। ও কোথায় যাবে? চাচা কাজ খুঁজতে শহরে গিয়েছিল ছয় মাস আগে। ফেরেনি। চাচি এখন গাঁয়ে নেই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। লােকমুখে এসব খবর পায় ও । 
 
চাচি তাে ওর খবর রাখে না। ও নিজে খবর নিলে তবেই খবর পাওয়া। ওই বাড়িতে কুন্তিই ওকে নিয়ে যা একটু ভাবে। কখনাে মােয়া-মুড়কি খেতে দেয়। এইটুকুই। অবশ্য এ নিয়ে ওর মাথাব্যথাও নেই।
 
আস্তে আস্তে গাঁয়ের মানুষের দিন সহজ হয়ে আসে। মিলিটারির আক্রমণের পর দুই মাস গড়িয়ে গেছে। যারা এদিক ওদিক পালিয়ে গিয়েছিল একেদুয়ে তারা অনেকে ফিরে এসেছে। শুনতে পায় অনেকে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ইন্ডিয়া কোথায় ও জানে না। জানার দরকার নেই। মােলক বুয়ার কথা খুব মনে পড়ছে। কোথায় যে গেল কে জানে। হরিকাকুরও কোনাে খবর নেই। যাদের কথা ও জানতে চায় তাদের খবর নেই। যারা ওর কেউ নয় তারাই আছে গী-জুড়ে। ওর চাচিও ফিরে এসেছে। কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হয়নি । ও যায়নি ওই বাড়িতে। শুধু দূর থেকে দেখেছে কুন্তি বড় হয়েছে। ওকে দেখতে এখন অন্য রকম লাগে। 
 
এর মধ্যে গায়ে আবার মিলিটারি আসে। ক্যাম্প বানায়। ক্যাম্পের পাহারায় থাকে ওদের কেউ কেউ। রাইফেল হাতে সেই ক্যাম্পের সামনে দাড়িয়ে ওদের দেখে। এমন মানুষ ও আগে কখনাে দেখেনি। ওরা কোথা থেকে এসেছে? কোথায় ওদের দেশ? ওরা কি এ দেশের মানুষ? ওরা যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাটা ও বুঝতে পারে না। গায়ের মানুষ কেউই ভালাে করে বুঝতে পারে না। দু-একজন ভাঙা ভাঙা ভাষায় কীসব বলে। সে ভাষা শুনতে আরও বিদঘুটে লাগে ওর। ওরা এ দেশের মানুষ হলে ও ওদের ভাষা বুঝতে পারবে না কেন? ও নিজের মতাে করে ভাবতে পারে না। কেমন বিদঘুটে লাগে। বােলতাটা কোথা থেকে উড়ে এসে ওর মাথায় বসে। বো বো শব্দ ওর কানে ঢোকে। যেন ফটফট শব্দে ফেটে যাচ্ছে বাঁশ, বাজারটা পুড়ছে। সেদিনের দৃশ্যটা ওর চোখের সামনে ফর্সা হয়ে যায় । সেদিনের পর একদিনও সেই দৃশ্যটা ও নিজের মগজে খােলসা হতে দেখেনি। আজ ক্যাম্পের সামনে একজন সৈনিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর মাথায় দৃশ্যটা নতুন করে ফিরে আসে। 
 
গুলি। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সালাম চাচা। 
গুলি। পড়ে গেল রবিদা। 
গুলি। পড়ে যায় একসঙ্গে অনেকে। 
 
ধানগাছের আড়ালে উবু হয়ে বসে থাকতে পারে না ও। ওর শরীর কাঁপে থরথর করে। হাজার হাজার বােলতা ওর কানের চারপাশে উড়তে থাকে। ও পড়ে যায়। ওর শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়। ও আবার উঠে বসে। দেখে পড়ে যায় মফিজ, শফি, মতি, আজাহার ভাই, মদন কাকু, শরিফ চাচা, আরও অনেকে। কারও নাম ভােলনি ও প্রত্যেকের নাম মনে আছে। চেহারা গেঁথে আছে বুকের ভেতর। একটা কিয়ামত ঘটিয়ে মিলিটারি চলে গেলে সেদিন বিকেলে গাঁয়ের আর সবার সঙ্গে লাশ দাফন করেছে ও। বাঁশঝাড় থেকে বাশ কেটে এনেছে। বরই পাতা দিয়ে পানি সিদ্ধ করেছে। জানাজা পড়েছে। শুধু এই প্রথম ও কাফনের কাপড় ছাড়া কবর হতে দেখেছে। আর অনেক মানুষের একসঙ্গে একটা কবর হতে দেখেছে। ওর বারবার বলতে ইচ্ছে করেছিল যে, এমন করে কবর দিও । সবাইকে আলাদা করে কবর দাও। কিন্তু বলতে পারেনি। শুধু হাবিব ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, এই গাঁয়ে একটা গণকবর হবে আমরা কি কোনাে দিন ভাবতে পেরেছিলাম? 
 
ও নিজেও কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করেছিল, গণকবর কী,হাবিব ভাই? 
এই যে সবাইকে একসঙ্গে গাদানাে। 
 
গাদানাে ! ভীষণ কষ্টে ও শব্দটা নিজের ভেতর টেনে নেয়। তারপর বিড়বিড়িয়ে বলে, প্রতিশোেধ! এমন হতে পারে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে ওর কষ্ট হচ্ছে। ওর ভেতরের বােলতাটা তীক্ষ হয়ে ওঠে। ও পলকহীন সৈনিকদের দিকে | ভাৰছে । ভীষণ ভাবনায় ও গম্ভীর হয়ে যায়। ভাবে, ওদের তাে একদিন এই গা থেকে চলে যেতে হবে। ওরা যেভাবে এসেছিল সেভাবেই একদিন ফিরে যাবে। ওদের যেতেই হবে। তবে ওদের কি জ্যান্ত ফিরে যেতে দেওয়া উচিত? একবার কলেরা মহামারি এই গাঁয়ে মৃত্যুর উৎপাত ঘটিয়েছিল। এবার মৃত্যুর উৎপাত শুরু করেছে ভিন্ন রকমের মানুষ। কলেরা সাত দিনের মাথায় চলে গিয়েছিল। এরা কি যাবে নাকি তাড়াতে হবে? কলেরাকে ও ছুঁতে পারেনি। কিন্তু ওই মানুষগুলােকে তাে ছুঁতে পারে। ওদের হাত-পা-মাথা-বুক-পিঠ সৰ ছোঁয়া যায়। কলেরা যখন এসেছিল তখন ও ছােট ছিল। এখন ও বড় হয়েছে। গায়ে জোর আছে। সাহস আছে। বুদ্ধি। 
 
আছে। তবে ছাড়বে কেন? ও বুঝতে পারে ওর, চোখ লাল হয়ে যায়। চোখ লাল হলে ওর ভেতরে একটা কিছু করার ইচ্ছা প্রতিজ্ঞা হয়ে যায়। ও বাজারে ফিরে আসে। ভাবে, কোথাও পালাবে না। দরকার হলে এই পোেড়া ঘরগুলাের নিচে খেঁকশিয়ালের মতাে গুটিয়ে-গাটিয়ে থাকবে। ও ছাই-কয়লা সরিয়ে ঘরের নিচে জায়গা করে নেয়। ঝাড়ু জোগাড় করে পরিষ্কার করে। বেশ ছিমছাম হয়। নিজের ছেড়া কাথাটা ভাজ করে এক জায়গায় রেখে দেয়। মাদুর বিছিয়ে নেয় মেঝেতে। বেশ লাগে এই পোড়া ঘর। ও চিত হয়ে শুয়ে দুহাত দুদিকে মেলে দেয়। ভাবে, ও এখন পােড়াঘরের কাকতাড়ুয়া। এভাবেই ও শিস বাজায়। শিস বাজাতে বাজাতে ওর ঘুম পায়। ও ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নে নিজের বুকের ভেতরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাওয়া অনুভব করে।
 
অনেক রাতে কখনাে কখনাে গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ওর। ওরা কি কাউকে মেরে ফেলল? এত রাতে কাকে? কোন মায়ের বুক শূন্য হয়ে গেল? ও বিড়বিড় করে বলে, তােমরা যারা আমাদের ঘর পােড়ালে, বাজার পােড়ালে, মানুষ মারলে, গায়ে গণকবর বানালে, লােকজনকে বাড়িঘর ছাড়ালে, তােমরা কি এমনি এমনি চলে যাবে? একটা ঘুষিও কি তােমাদের পাওনা হয়নি? আমরা কি এতই দুর্বল? কলেরা আমাকে খেতে পারেনি। আমি তােমাদের জন্য বেঁচে আছি। আমার হাত দিয়েই তােমাদের একটা কিছু পাওনা হবে। ঠিক, দেখাে, একটা কিছু তােমাদের আমি দেই। ও ছাদের ফুটো দিয়ে তারাভরা আকাশের দিকে তাকায়। তবে কি বঙ্গবন্ধু এই মানুষগুলাের বিরুদ্ধে লড়ার লছিলেন? হ্যা, এরাই তারা! ও ঠিক বুঝে গেছে। কারও কাছে জিজ্ঞেস করে এ কথা আর জানতে হবে না। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ও কানু দয়ালের বাড়িতে বসে রেডিওতে শুনেছিল। সেই রক্ত গরম করা ভাষণ শুনে ও মধুকে বলেছিল, এখন থেকে তােরা আমাকে বঙ্গবন্ধু বলে ডাকবি।
 
ইস শখ কত! বানরের আবার চলে যাওয়ার সাধ। 
কী আমি বানর? 
হ্যা, বানর। 
 
তুই একশবার বানর। মধু হি-হি করে হেসেছিল। সেই মধু আর নেই। আগুনে পুড়ে গেছে। ও চিনতে পারে নি কোনটা মধুর লাশ। মধুর মা-বাবা গাঁয়েই আছে। এখনাে পালায়নি। মধুর বড় ভাই মিঠু লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে। জোয়ান ছেলেদের যে ওরা ধরে নিয়ে মারছে। এতকিছু ভেবে ওর ভীষণ কান্না পায়। দুইবছর আগের সেই শীতল মৃত্যুর রাতের কথা মনে পড়ে। সেই রাতে বাবা মারা যাওয়ার পরও মা জীবিত ছিল। ওকে ডেকেছিল। বাবা বুধা, বাবা, বাবা রে? 
 
ওহ সেই কণ্ঠ কেমন শীতল, যেন মৃত্যুপুরীর হাওয়া বয়ে এসেছিল ওর কাছে। ও হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল মায়ের ওপরে, মা, মাগো। 
 
বাবা, তােকে আল্লাহর ভরসায় রেখে গেলাম। বাবা রে 
মাগাে! 
 
আর কোনাে কথা ছিল না। আর কেউ ওকে কিছু বলেনি। টুপটুপ করে ঝরে গেছে কেবল। গাছ ঝাকানি দিলে যেমন বরই ঝরে পড়ে তেমন। ও পাগলের মতাে চিৎকার করেছিল। গিয়েছিল চাচার ঘরের দরজায়। বলতে চেয়েছিল, তােমরা দেখ, এই ঘরের ভেতর কী হচ্ছে। বলা হয়নি। ও মৃত্যুপুরীর স্তব্ধ শীতলতায় নিঃসাড় বসেছিল। ভাবলে এখন আর বুক মােচড়ায় না, শরীরটা তাে জমাট শক্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ মনে হয়, কে যেন ডাকছে। 
 
বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু। 
এই তাে আমি এখানে। 
 
ও উঠে বসে। কোথাও কেউ নেই। ও নিজের বুকের কথাই শুনতে পাচ্ছে। ফুটো ছাদ দিয়ে বাতাস ভরে যাচ্ছে ভাঙা ঘরে। ও বুকভরে শ্বাস টেনে বসেই থাকে। কদিন ধরে ও খেয়াল করছে গাঁয়ের কয়েকজন টাকাওয়ালা মানুষ; যারা গী থেকে পালায়নি, তারা মিলিটারির সঙ্গে বেশ যােগাযােগ করছে। ওদের ক্যাম্পে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, মাছ, ডিম, দুধ পাঠাচ্ছে। সৈনিকগুলাের ভীষণ ফুর্তি। খায়দায় ঘােরাফেরা করে। দরকারমতো একেওকে ধরে নিয়ে যায় । ক্যাম্পের সামনে বেঁধে রাখে। নয়তাে কোথায় যে গায়েব করে দেয় ওর আর খোঁজ পাওয়া যায় না। ও পােড়াঘরের নিচে বসে ছটফট করে। মিলিটারি তাে বিদেশি মানুষ। ওরা এ গাঁ চেনে না। ভাষা জানে না। ওদের আপন ভাৰা যায় না। কিন্তু দেশের মানুষ কেন ওদের সঙ্গে মিশেছে? কেন বিদেশিদের মতাে আচরণ করছে? গাঁয়ের মানুষদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে? তারপর ওদের লাশ খেতে উড়ে আসে শকুন। বিদেশি মানুষ এবং নিজেদের মানুষ সবার ওপর ওর ঘৃণা বাড়তে থাকে। ভাের হলে ও পােড়া ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দিনের বেলা ও নিজের বুকের কথা শুনতে পায় না। রাতই ওকে তাড়ায় বেশি। ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। খাবে কী? 
 
ও বাজারের মাঝ দিয়ে হাঁটতে থাকে। কেউ কেউ আবার নতুন করে দোকানঘর তােলার চেষ্টা করছে। আলি কড়ইগাছের নিচে বাঁশের বেঞ্চি বানিয়ে চা বিক্রি করতে শুরু করেছে। আলি ওকে বলেছে, ওই শৱদের না তাড়িয়ে আমি আর চায়ের দোকান বানাব না। তুই যত দিন খুশি ওই পােড়া ঘরে থাকবি। ওকে দেখেই আলি ডাক দেয়। 
বুধ, এদিকে আয় । 
খিদে পেয়েছে, আলি ভাই।। 
নে, চা-বিস্কুট খা। এতে হবে না? 
খুব হবে। আমি কি কোনাে দিন দুটো বিস্কুট একসঙ্গে খাই? 
 
আলি হাসতে হাসতে বলে, আমি তাে জানি তুই কী খাস! রােদ খেলে তাের পেট ভরে। জোছনা খেলে তাের মন ভরে। বৃষ্টির পানি খেলে তাের বুক ভরে, বাতাস খেলে তাের মগজ ভরে, তুই আর কী খাস রে, বুধা? 
 
ও প্রবল হাসিতে ভেঙে পড়ে। ততক্ষণ ওর বিস্কুট খাওয়া শেষ হয়েছে। ও চায়ের কাপে চুমুক দেয়। আলি দেখতে পায় তৃপ্তিতে ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একে-দুয়ে মানুষ এসে বসে। বড় গলায় কথা বলে না। চুপচাপ থাকে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ ভিজে ওঠে। কারও কারও চোখে আগুনের ফুলকি ছােটে। কেমন করে যে তাকায়, তা বােঝা যায় না। ছেলেটির মনে হয় এ গাঁয়ের কারও এমন দৃষ্টি ও কোনাে দিন দেখেনি। মানুষগুলাে বদলে যাচ্ছে। একদিন সবাই মিলে অবাক হয়ে শােনে, গায়ে শান্তি কমিটি হয়েছে। আহাদ মুন্সি চেয়ারম্যান । ছেলেটি বুঝে যায় গায়ের মানুষ দুভাগ হয়ে গেছে। এক দল আলির চায়ের দোকানে এসে বসে। নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলতে চায়। অন্য দল আহাদ মুন্সির দলে। মিলিটারির ক্যাম্পের পাশে ঘােরাফেরা করে। আকস্মিকভাবে ও চেঁচিয়ে ওঠে, ‘যুদ্ধ, যুদ্ধ! মানুষ যখন দুভাগ হয়ে যায় তখন তার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ নামের নদী বইতে থাকে। এখন থেকে ওর নাম যুদ্ধ। ও নিজের ভেতরে জোশ অনুভব করে। একছুটে বড় সড়কের ধাৱে আসে। আর একছুটে নদীর ধারে যাওয়ার সময় মুখােমুখি হয় আহাদ মুন্সির। 
 
ও বিনীত ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে বলে, স্লামালেকুম, চেয়ারম্যান সাহেব। 
 
আহাদ মুন্সি বিগলিত হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছেলেটির সরল চেহারা দেখে তার মায়া হয়। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, তাের নামটা যেন কী রে? মনে করতে পারছি না। 
 
আমার নাম যুদ্ধ। 
 
যুদ্ধ? আহাদ মুন্সির চোখ কপালে ওঠে। বলিস কী? তুই কি পাগল নাকি? 
 
পাশে দাঁড়ানাে লােকটি ঝটপট বলে, হ্যা, হুজুর একদম পাগল । 
 
আরেকজন বলে, চলেন চেয়ারম্যান সাহেব, ওটা তাে একটা পাগল পােলা। ওই যে কলেরায় ওর মা-বাবা সব মরেছে না! এক রাতে সব শেষ। তারপর থেকে ওর মাথার ঠিক নাই।। 
 
আহা রে, আসিস আমার বাড়িতে। গরু চরানাের কাজ দেব। পেটেভাতে থাকবি। 
 
কিন্তু একটা কথা, চেয়ারম্যান সাহেব… 
 
কী? কিছু বলবি? টাকা দিতে পারব না, বাপু। আমার পকেটে এখন টাকা নাই। 
 
আমি আপনার কাছে টাকা চাই না। আমি যার-তার কাছে হাত পাতি না। 
 
কী বললি? বললাম, আপনি তাে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। কিন্তু সারা দেশে যে অশান্তি। শান্তি কই?
 
চুপ বেয়াদ্দব। 
 
নাম রাখলেন বেয়াদ্দব? ভালাে। কেউ আমার নতুন নাম রাখলে আমি খুব খুশি হই। 
 
‘বেয়াব, বেয়াদ্দব’ বলতে বল তে ও পথে নামে। তারপর হা-হা করে হাসতে থাকে। ওর হাসির তােড় আহাদ মুন্সির দুকানভরে বাজে। লােকটি ভুরু কুঁচকে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। যাওয়ার কথা ভুলে যায়। 
 
চেয়ারম্যান সাহেব চলেন। 
 
যাব! আহাদ মুন্সি অন্যমনস্ক কষ্ঠে বলে । 
 
হ্যা, যাবেন তাে। একটা বানরের কথায় আপনি এত কী ভাবছেন? 
 
ভাবছি না তাে। তা হলে? 
 
চল যাই। 
 
আহাদ মুন্সি হাঁটতে থাকে। কিন্তু বাকি পথটা সে আর কারও সঙ্গে কথা বলে না। 
 
বিকেলে চায়ের দোকানে বসে থাকার সময় ছেলেটির মনে হয় আলি আর মিঠুকে একদম একরকম লাগছে। দুজনের চেহারায় অদ্ভুত ছায়া খেলছে। ও মনে মনে বলে, আশ্চর্য। আমি যে কথা ভাবছি ওরা ঠিক সে কথাই ভাবছে। কেমন করে এমন ভেতরে ভেতরে এক হয় মানুষ? এক হওয়ার এখনই তাে সময়। এক হতে না পারলে এই বিদেশি সৈনিকগুলাে ওদের মেরে ভূত বানিয়ে ফেলবে। গ্রামটা হয়ে যাবে একটা শশান। যেখানে মানুষ থাকবে না, থাকবে মানুষের প্রেত। ভাবতে ভাবতে ও হি হি করে হাসে। হাসতে ওর মজাই লাগে। 
 
মিঠু বলে, হাসছিস কেন, বুধ? 
 
ভূত
 
আলি ও মিঠু একসঙ্গে বলে, ভূত কী রে? 
 
আমরা লড়াই না করলে গ্রামটা একদিন ভূতের বাড়ি হবে। না, ভুল বললাম। ভূত না, গ্রামটা ভরে যাবে মানুষের প্রেতে। ওরা সংখ্যায় বেশি হবে না। কিন্তু ওদের বড় বড় পা, হাত, মাথা দিয়ে ওরা গ্রামটা ভরে ফেলবে। 
 
কী বলছিস, বুধ? 
 
হি-হি করে হাসে ও | হাসতেই থাকে। আলি বলে, আবার হাসছিস কেন? 
 
আপনাদের দুজনকে একরকম দেখাচ্ছে। আপনারা কী দুজল না, একজন?
 
 তুই তাে বেশ ধেড়ে ছেলে রে। 
 
আলি ও মিঠু এবার হাসতে থাকে। 
 
আপনারা হাসেন কেন? 
 
আমরা তােকে বুঝতে পারছি রে। 
 
কেমন? 
 
তােকে ধরলে আমরা এখানে তিনজন। কিন্তু আমরা তিনজন নই, একজন। ঠিক না?
 
হ্যা ঠিক। 
 
ছেলেটি গম্ভীর হয়ে বলে।। 
 
মিঠু জিজ্ঞেস করে, তিনজন একজন হলে কী হয়, জানিস তাে?
 
জানি। শক্তি বাড়ে। বড় শক্তি হয়। এক হলে লড়াইয়ে শত্রুরা হারে। 
 
শাবাশ! তােকে দিয়েই হবে। 
 
ফেরার সময় ছেলেটি আলির কাছ থেকে এক শিশি কেরােসিন চেয়ে নিয়ে আসে। বলে, আমি গায়ে খেটে তােমার তেলের দাম শােধ দেব, আলি ভাই।’ 
 
ওইটুকু তেলের দাম শােধ দিতে হবে না। 
 
হ্যা, দিতে হবে না। আমরা জানি তুই ভালাে একটা কিছু করার জন্য তেল নিয়েছিস। মিঠুকে সমর্থন করল আলি। দুজনে গভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ও হেসে মাথা নেড়ে পথে নামে। পােড়া ঘরে ফিরে বুধা বাঁশের লাঠির মাথায় শুকনাে পাট জড়িয়ে মশাল বানায়। চারটা মশাল। গভীর রাতে পথে নামে ও। গাছগাছালি, ঝোপঝাড়ের আড়ালে চুপিচুপি আহাদ মুন্সির বাড়ির দিকে এগােয়। গােয়ালঘরের পেছনে কচুর ঝােপ আর কলাগাছের পেছনে বসে শিশির কেরােসিন ঢেলে চারটা মশাল ভিজিয়ে নেয়। তারপর দেশলাই ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে বড় মশালটা ছুড়ে মারে আটচালা ঘরের ওপর। একটা কাছারিঘরের ওপর । আর একটা রান্নাঘরে। অন্যটা গােয়ালে। দাউদাউ জ্বলে ওঠে ছনের চালা । মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে যায়। ঘুমন্ত মানুষগুলাে জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসতে ব্যস্ত। ঘর বাচানাের খেয়াল কারও নেই। অল্পক্ষণের মধ্যে বসতবাড়ি পুড়ে সাফ। মশাল ছুড়ে ও আর অপেক্ষা করে নি। সবাই যখন ছােটাছুটি, কান্নাকাটিতে ব্যস্ত তখন ও ঝােপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পালাতে থাকে। অল্পক্ষণে ফিরে আসে পােড়া ঘরে। একটু পর পায়ের শব্দ শুনে ও ফিসফিসিয়ে বলে, কে ওখানে? 
 
জয় বাংলা। 
 
ও বুঝে যায় আলির কণ্ঠ। 
 
আবার ধ্বনি হয়, জয় বাংলা। এটা মিঠুর কণ্ঠ। 
 
জয় বাংলা বলে, ও নিজেও বেরিয়ে আসে। ওরা দুজন জড়িয়ে ধরে ওকে। আলি বড় এক বােতল কেরােসিন ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই বােতলটা রাখ। দরকারমতাে কাজে লাগাবি। এখন থেকে তাের নতুন নাম জয় বাংলা। 
 
তুই আমাদের শক্তি। আমাদের জয় বাংলা। 
 
জয় বাংলা বলে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ব। 
 
ছেলেটি হিহি করে হাসে। রে বুকের ভেতরে প্রানের জোয়ার। উথাল-পাথাল বয়ে যায়।
 
 
হাসছিস যে? 
 
খুশিতে। 
 
উহ্ মাগাে, এমন খুশি আমার জীবনে আর আসেনি। বাবা-মা-ভাই-ৰােন মরে যাওয়ার পরে আমি তাে জানতামই না যে খুশি কী? 
 
জয় বাংলা খুশি যা হয়েছিস তা ঠিক আছে। তবে ভুলে যাস না যে এখন কাজের সময়। 
 
হা, হা জানি, সামনে আমাদের অনেক কাজ। 
 
কঠিন কাজ। 
বড় কাজ। 
ও আবার হি-হি করে হাসে। ওর হাসিতে তারার ফুল ফোটে। আলি আর মিঠু মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখে।
 
 
আমরা চলে যাচ্ছি, জয় বাংলা। আহাদ মুন্সি আমাদের ছাড়বে না। ঠিকই সন্দেহ করবে। আজ রাতেই পালাবো। তুই সাবধানে থাকিস। তুই তাে ছােট, তােকে এখনই সন্দেহ করবে না। 
 
মিঠু ওকে জড়িয়ে ধরে। 
 
আলি বলে, আমরা মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিতে যাচ্ছি। ওই মিলিটারি ক্যাম্পটা উড়িয়ে দিতে হবে। সময়মতাে আসব জয় বাংলা। তুই ভয় পাস না। 
 
আমি তােমাদের জন্য তৈরি হয়ে থাকৰ। যখনই আসবে দেখৰে আমি রেডি। 
 
শাবাশ। তােকে দেখেই বুঝতে পারছি যে দেশটা স্বাধীন হবে। 
 
তােকে দেখে আমাদের সাহস বেড়ে গেছে। এখন আমাদের মরতেও ভয় নেই। 
 
দুজনে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ওর মনে হয় অন্ধকার ওদের বুকে টেনে নিল। আড়াল করে দিল সৈনিকগুলাের চোখের সামনে থেকে। 
 
ওরা চলে গেলে সেই রাতে ও আর ঘুমুতে পারে না। কড়ইগাছের নিচে বাঁশের মাচাটার ওপর চিতপাত হয়ে শুয়ে থাকে। আকাশের হাজার নক্ষত্র দেখে! আজ ওরা ওর নাম রেখেছে জয় বাংলা। এক তীব্র আনন্দ ওকে এমন করে ভরিয়ে রাখে যে ও ভুলে যায় দুঃখ-বেদনার কথা। ও ঘুমিয়ে পড়ে। 
 
ভােরবেলা আহাদ মুন্সির বড় ছেলে ওকে কান ধরে টেনে তােলে। ও ঘুম-জড়ানাে চোখে মতিউরের দিকে তাকায়। এই শুয়ােরের বাচ্চা, ওঠ।। শুয়ােরের বাচ্চা? 
 
ও ঠিকমতাে চোখ খােলে। 
 
আলি কোথায়? 
 
জানি না । 
 
তুই জানিস, বল? 
 
কেমন করে জানব? আলি আমার কে? ও কি আমার মায়ের পেটের ভাই? 
 
ইস, ঢং দেখানাে হচ্ছে। একটা পিচ্চি শয়তান।
 
আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে কে? 
 
আগুন্ । 
 
আগুন কী জানিস না? মতিউর রেগেমেগে ওকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত ওঠানাের সঙ্গে সঙ্গে ও দু-পা পিছিয়ে গিয়ে আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে করতে নদীর ঢালু বেয়ে নেমে যায়। অনেকখানি নেমে গিয়ে থমকে দাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকায়। দেখে মতিউর একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ও ওর আচরণের হদিস করে উঠতে পারে না। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে জিব বের করে ভেংচি কাটে। তারপর কাকতাড়ুয়া সেজে দাঁড়িয়ে থাকে। মতিউর নদীর পাড়ে দাড়িয়ে ওকে গালাগাল করে, তাের সামনে খারাপ দি আছে,বুধা। তােকে পেলে আমি চিবিয়ে খাব। বান্দর একটা। মনে রাখিস–
 
মতিউরের হম্বিতম্বিতে লােক জড়াে হয়। 
 
একজন বলে, ওকে মাফ করে দেন। ওর কি মাথা ঠিক আছে। বাপ-মা মরা। 
 
আরে রাখেন বাপ-মা মরা। বাপ-মা যেন আর কারও মরে না। 
 
মতিউর প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে ফুসতে চলে যায়। বুধা নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। ওর ঘাড় কাত করা। মাথার ওপর শুকনাে পাতা ঝরে পড়ে। কেউ জানে না ও কখন ওর কাকতাড়ুয়া ভঙ্গি থেকে সরে আসবে। 
 

পরদিন গায়ের রাজাকার কমান্ডারের বাড়িতে আগুন লাগে। পুড়ে যায় সবগুলাে ঘর। শুধু মানুষের জীবন বাঁচে, আর গরু-ছাগলগুলাে বাঁচানাে যায়। কোথা থেকে কীভাবে আগুন লাগল- হদিস করতে পারল না বাড়ির লােকজন।

রাজাকার কমাণ্ডার কাজের মেয়েটিকে আচ্ছা করে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিল। তার ধারণা, কাজের মেয়েটি রান্না করার পরে নিশ্চয় পাঠখড়িগুলাে চুলাের পাশে রেখে দিয়েছিল। সেখান থেকে আগুন লেগেছে। বাড়ির বাইরের জামগাছের নিচে বসে মেয়েটি অনেকক্ষণ কাদল। বুধা মেয়েটিকে দুটো জিলাপি দিয়ে বলল, খা।

মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি পাটখড়ি চুলার পাশে রাখিনি, বুধা। আমি জানি না কীভাবে আগুন লাগল ।

বুধা ওর পাশে বসে। তারপর কোমরে গুঁজে রাখা মলমের ছােট্ট কৌটাটা ওর হাতে দিয়ে বলে, যেখানে যেখানে কেটেছে সেখানে লাগিয়ে দে।

মলম?

হ্যা, তাের জন্য এনেছি। রাজাকার কমাণ্ডার যখন তােকে মারছিল তখনই বুঝেছিলাম যে এই মলমটা তাের লাগবে।

লাগিয়ে দে জ্বালাপােড়া কমবে। আহা রে যুদ্ধের জন্য আমাদের কত কিছু সইতে হয়।

যুদ্ধ। মেয়েটি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। যুদ্ধ কোথায়? আগুন লাগা কি যুদ্ধ?

ধর,এক রকম তাই। আমি এমনি বললাম। ভাের নাম কী রে?

ফুলকলি।

চল আমার সঙ্গে।

কোথায়?

আতা ফুপুর বাড়িতে।

ওখানে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে থাকবি।

এখন গেলে ওরা আমাকে মারবে।

মারবে না। এরা এখন ঘর-দুয়ার নিয়ে ব্যস্ত। এদের মেজাজ ঠাণ্ডা হােক, তারপরে আসবি। তাের তাে কেউ নেই। কোথায়ই ৰা যাবি। আয় ।

বুধা ফুলকলির হাত ধরে টানে। দুজনে সবার চোখ এড়িয়ে পথে নামে। যেতে যেতে ছেলেটি বলে, তাের কি খুব কষ্ট হচ্ছে, ফুলকলি?

মলম লাগানাের পর জ্বালা কমেছে। যুদ্ধের সময় কত জ্বালা যে সইতে হয়।

তুই বারবার যুদ্ধের কথা বলছিস কেন?

তুই কি যুদ্ধ করছিস?

হ্যা।

কার সঙ্গে?

শক্রর সঙ্গে।

শত্রু।

তাহলে তুই-ই কি আগুন…

আগুন! আগুন! অামাদের চারদিকে আগুন। আয় দৌড়াই।

বুধা ফুলকলির হাত ধরে হেঁচকা টান দেয়। মেয়েটি হোঁচট খেতে খেতে সামলে নেয়। একসময় দম নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে বলে, আমি সব বুঝতে পেরেছি, বুধা। আমি তাের শত্রু নই।

আমি তাে জানি তুই আমার শত্রু নস্। আমরা দুজনে এক! ওই বাড়িতে কিছু ঘটলে আমি তােকে জানিয়ে দেব। ফুলকলি এখন থেকে তােকে আমি জয় বাংলা ডাকব।

জয় বাংলা, জয় বাংলা জয় বাংলা, জয় বাংলা বলতে বলতে ফুলকলি আবার ছুট দেয়। এবার ওদের দম ফুরােয় । ওরা একদৌড়ে আতা ফুপুর বাড়িতে এসে ওঠে। ফুলকলি ফিসফিসিয়ে বলে, এখন থেকে তােকে আমি যুদ্ধ ডাকব, বুধ।

ডাকিল, তবে একা পেলে। সবার সামনে ডাকিস না ।

আচ্ছা। ফুলকলি ওর দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। বুধা চেঁচিয়ে ডাকে, ফুপু, ফুপু। আমি এসেছি।

খুব ভালো করেছিস। ওমা ফুলকলি যে? তােদের বাড়িতে আগুন লেগেছে না?

মালিক ওকে খুব মেরেছে, ফুপু। তােমার হাঁড়িতে পান্তা আছে, ফুপু? আমাদের খেতে দাও।

সেদিন ভােরবেলা আতা ফুপুর রান্নাঘরে বসে পেট ভরে পান্তা ভাত খায় ও কী আনন্দ। অনেক দিন পরে আতা ফুপুর উঠোনে ও কাকতাড়ুয়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বােলতাটা কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেলে মনে হয় বােলতার ডাকের ভেতর থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটা অন্য রকম। আগে শােনেনি। এটা কি যুদ্ধের শব্দ? রাইফেলের শব্দ ও চিনে গেছে। মেশিনগান কেমন তাও জানে। এসব মিলিয়ে যে শব্দ হয়, সেটাই বুঝি যুদ্ধের শব্দ! কাছ থেকে এই শব্দটি ওর শােনা হয়নি। ঠিক সে সময় রাজাকার কুদ্স ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।

তাের মনে কি খুব আনন্দ? কাকতাড়ুয়া সেজেছিস কেন?

ও হি-হি করে হাসে। হাসির তােড়ে ওর কাকতাড়ুয়া ভঙ্গি আর ঠিক থাকে না। ওর শরীরে ঝাঁকুনি ওঠে।

হাসছিস কেন? তাের হয়েছে কী? কমান্ডারের বাড়ি পুড়েছে তাতে গাঁয়ের মানুষ সবাই দুঃখ করছে। আর তুই হাসছিস? ঢং করে আবার কাকতাড়ুয়া সাজা হয়েছে।

হাসৰ না কেন? কাকতাড়ুয়াকেও মানুষের মতাে লাগে যে।।

বানর একটা।

ঠিকই, তােমার মতাে। আমি তােমার মতাে হয়েছি। কী আনন্দ ধেই, ধেই। নৌকা চালাও হেঁইও।

কুদুস কষে থাপ্পড় মারার জন্য হাত তােলার আগেই ও লাফ দিয়ে সরে যায়।

হাতের কাছে পেলে তুলে একটা আছাড় মারব, শয়তান। মিঠু কোথায় বল?

নদীর তলে খুঁজে দেখ। আমাকে জিজ্ঞেস কর কেন? আমি কি ওদের গাজ্জিয়ান?

শুয়ােরের বাচ্চা।

মেশিনগান বল, আমার নাম মেশিনগান।

হারামজাদা।

কুদ্স ওকে তাড়া করে। ও লাফ দিয়ে ছােটে। কচুরিপানাভরা পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে একডুবে ওপারে গিয়ে ওঠে। মাথার সঙ্গে লেগে থাকে কচুরিপানা। ওকে অন্য রকম দেখায়। ও মাথা থেকে কচুরিপানা সরায় না। ভাবে, ফুলকলি সামনে থাকলে হেসে গড়িয়ে পড়ত। বলত, তুই একটা ভাল্লুক। থলথলে চর্বিভরা শরীর। ফুলকলির অনেক দুঃখ। দেশটা স্বাধীন হলে ফুলকলির আর দুঃখ থাকবে না। ওর ভেতরে দেশ স্বাধীন করার জোশ জেগে ওঠে।

পরদিন্ অনেক রাতে একজন মুক্তিযােদ্ধা আসে ওর কাছে। চুপিচুপি ডাকে, জয় বাংলা।

ওর সাড়া নেই। ঘুমে নিঃসাড়। ঘুমের ভেতরে স্বাধীনতার স্বপ্ন ওকে এক আশ্চর্য দেশে নিয়ে যায়। সেখানেও ও আর ফুলকলি হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। চারদিকে ফুল-পাখিতে ভরা। হাজার প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। ও ধরার জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু ধরতে পারে না। অন্যদিকে ফুলকলি শত শত প্রজাপতি ধরে ওর কোচড় ভর্তি করে ফেলে। ফুলকলি উজ্জ্বল মুখে ঘুরে বেড়ায়। তারপর একসময় ওর কাছে এসে বলে, বুধা, এ সব প্রজাপতি তাের জন্য। তুই যে আমার জন্য একটা যুদ্ধ জিতেছিস।

ও চেঁচিয়ে বলে, আমি জিতেছি?

হ্যা রে জিতেছিস। দেখ চারদিকে কেমন বাজি ফুটছে। দেখ তাের মাথায় আমি প্রজাপতি ছড়িয়ে দিচ্ছি।

ও দেখতে পায় ওর পুরাে শরীরে প্রজাপতি জামার মতাে সেঁটে আছে। ও ভীষণ খুশি হয়ে একটি প্রজাপতি ধরে আকাশে ওড়াতে থাকে। ফুলকলি হাততালি দেয়।

তখন ওর ঘুম ভেঙে যায়। কে যেন ওকে ডাকছে।

বঙ্গবন্ধু? এই মেশিনগান?

ও ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। আশ্চর্য, ঘরে এত আলাে কেন? রাত না দিন?

এই যুদ্ধ উঠে আয়। কি রে তাের ঘুম কি ভাঙেনি? আমার ডাক কি তাের কানে পৌছাচ্ছে না?

আশ্চর্য, কার কণ্ঠ? বােলতাটা কি কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেল? ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, আমি তাে তােমাদের জন্য বসে আছি। এত দিন আসােনি কেন? আমার কাছে পৌছাতে তােমাদের এত সময় লেগেছে কেন?

চুপ করে আছিস কেন, কাকতাড়ুয়া?

হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে। ওকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে মুক্তিযােদ্ধা শাহাবুদ্দিন। শাহাবুদ্দিন তাে ছবি আঁকে। আর্ট কলেজে পড়ে। তা হলে শাহাবুদ্দিনও যুদ্ধ করছে। ওহ্ যুদ্ধ, যুদ্ধ।

বুধা শাহাবুদ্দিনকে স্যালুট করে। শাহাবুদ্দিন ভুরু কুঁচকে বলে, কি রে স্যালুট করলি কেন?

আপনি তাে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার। স্যালুট করব না? কী যে বলেন?

ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই একটা বাহাদুর ছেলে আমি শুনেছি।

ছেলেটি হাসতে থাকে। তারপর শাহাবুদ্দিনের হাত ধরে মাচানের ওপর এসে বসে।

আলি আর মিঠুর কাছে তাের কথা শুনেছি। তুই তাে এই গাঁয়ে একাই যুদ্ধ করছিস।

যুদ্ধ? আমি?

হ্যাঁ রে। ওই যে বাড়িগুলাে পুড়িয়েছিস, এটাও যুদ্ধ। এবার বড় যুদ্ধ করতে হবে।

সেটা কী?

মিলিটারির ক্যাম্পটা উড়িয়ে দেব আমরা। তুই থাকবি আমাদের সঙ্গে।

রেকি করার কাজটা তােকে করতে হবে।

এ আর এমন কী কঠিন কাজ, খুব পারব।

জানি তাে তুই পারবি। শােন কয়টা সেপাই পাহারা দেয়, কয়জন তাঁবুর ভেতর থাকে, মেশিনগানটা কোথায় ফিট করে রেখেছে—সৰ খবর নিয়ে আসবি। আমি আবার দুদিন পরে আসব । যা ঘুমিয়ে পড়।
কীভাবে ফিরবেন?

নৌকায় নদী পেরিয়ে চলে যাব। ভয় পাস না ।।

ছেলেটি আবার নিজের খড়ের বিছানায় ফিরে আসে। গুটিসুটি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমুলাের আগে ওর মনে হয়, ভয় কী সে তো ও কবেই ভুলে গেছে। নতুন করে আর ভয়ের কী আছে ওর জীবনে। এখন তো ওর জীবনের চারদিকে ভাক-ডুমাডুম ঢােল বাজছে। এই বাজাের নিচে ওর ভয় চাপা পড়ে গেছে। ওকে আর ভয়ের ভূত ধরতে পারবে
; বরং ও এখন ওর শৈশবের আনন্দের দিনগুলাে খুঁজে পায়। যখন বাবা-মা বেঁচেছিল সে সব দিন। কত দিন বাবার সঙ্গে হাটে গিয়েছে। ইলিশ মাছ কিনেছে। মা রান্না করেছে। ইলিশের গন্ধে ওর ভাইবেলে বসে থাকত চুলাের পাশে। শীতকালে মা ভাপা পিঠা বানাত। কী আনন্দের ছিল সে সব দিন। স্বাধীনতার স্বপ্নে ও আবার সে সব দিনের আনন্দ ফিরে পেয়েছে। এখন ওর আর কোনাে ভাবনা নেই। মরণেও ভয় নেই।

পরদিন ও একগাদা পেয়ারা নিয়ে মিলিটারি ক্যাম্পে যায়। গায়ের স্কুলঘরটি দখল করে ওরা ক্যাম্প বানিয়েছে। সামনের মাঠে বেশ কতগুলাে তাবু টাঙানাে । ও এত দূর থেকে তাবু দেখতে পায় না। কিন্তু দৃশ্যটি ওর মাথায় আছে।

সেটা পরিষ্কার। দুপাশের ধানখেতের ভেতর দিয়ে সােজা চলে যাওয়া লম্বা পথটা পেরিয়ে ডান দিকে এগােলে স্কুলঘর। মা-বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে ওর স্কুল বন্ধ। এর মধ্যে দুই বছর পেরিয়েছে। স্কুলের স্মৃতি ও মনে করতে চায় না। এটা বুকের ভেতর বন্ধ করে রেখেছে। চমৎকার নকশা করা রঙিন একটা বাক্স আছে বুকের ভেতর। গত দুই বছরে সে বাক্স খােলার ইচ্ছে ওর হয়নি। এখন ওই স্কুলের দিকে যত এগােচ্ছে ততই মাথার ভেতর বােলতার শব্দ তীব্র হয়ে উঠছে। দুই বছরে কত হাজার বার স্কুলের আশপাশে ঘুরেছে। স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলেছে। রাতে স্কুলের বারান্দায় ঘুমিয়েছে, আর দুকান ভরে শুনেছে ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ। আশ্চর্য! মাথার ভেতর প্রবল শ্রাবণ মাস। রাতভর বৃষ্টি। ও ডান হাতের ওপর মাথা রেখে স্কুলের খেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। কঠিন রাত শেষ হবে না বুঝি। সেদিন ওর কেয়ামতের দিনের কথা মনে পড়েছে। মৌলৰি সাহেব বলেছেন, কেয়ামতের দিন মাথার এক হাত ওপরে সূর্য নেমে আসবে। এমন বৃষ্টিমুখর শ্রাবণের রাতে ওর কেয়ামতের দিনের সূর্যের কথা মনে পড়ছে কেন? সূর্য কি শব্দ করে? বৃষ্টির শব্দ নয়, চারদিকে তুমুল ঘন্টাধ্বনি। টুং-টং-টং। কবেই তাে স্কুলের দিনগুলাে শেষ হয়ে গেছে। তুমুল ঘণ্টধ্বনি কেন ওকে টানে? শ্রাবণ মাসের প্রবল বৃষ্টি ওর দুচোখ বেয়ে গড়াতে থাকে। ও মােছে না।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম স্কুলের দিকে যাচ্ছে। মাথার ওপর খাঁ-খাঁ দুপুর। চড়া রােদ। ও জানে, এই যুদ্ধের সময় আবার শ্রাবণ মাস এসেছে। বৃষ্টি নেই। চড়া রােদে ওর শরীর ঘামতে থাকে । জামার পকেট পেয়ারা। কোমরে গোজা পেয়ারা। ভাসা। ও ভাবে, একটি পেয়ারা কি খাবে? ভাবতে ভাবতে অনেকটা পথ চলে আসে। পেয়ারাগুলো তাে হাতে বন্দুক নিয়ে লােহার টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা লােকগুলাের জন্য নিয়েছে। ওদের সঙ্গে পেয়ারা খাওয়ার আড্ডা জমিয়ে তুলবে বলেই না এত উঁসা পেয়ারা সগ্রহ করা ।।

নদীর ধারে গাছগুলাের পেয়ারা খেয়েই তাে ওর রাত কেটে যায়। ও বেশ গান গাইতে গাইতে এগােতে থাকে।এগােতে চঞ্চল হয়ে ওঠে। আশ্চর্য, এত কাছ থেকে সৈনিকগুলােকে ওর দেখা হয়নি। ওদের চোখে চোখ পড়লে ওর দৃষ্টি কেপে ওঠে না। ও বুঝে যায় প্রাণহীন দৃষ্টি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যে দৃষ্টিতে ভাষা থাকে না, সে রকম দৃষ্টিহীন মানুষকে ওর মানুষই মনে হয় না।

ক্যাম্পে পৌছে ও প্রথমে নিজে একটি পেয়ারায় কামড় দেয়। আরেকটি পেয়ারা এগিয়ে দেয় প্রথম সৈনিকটির দিকে। ইশারায় বলে, খাবে?

লােকটি দাঁত কেলিয়ে হেসে পেয়ারাটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় ওর হাত থেকে। কামড় দিয়ে বলে, বহুত আচ্ছা, বহুত মিঠা। আর হ্যায়?

ছেলেটি সবগুলাে পেয়ারা বের করে মাটিতে ফেলে দেয়। আশপাশ থেকে আরও দু-চারজন সেপাই এগিয়ে আসে। দুজন পেয়ারাগুলাের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ভাললাগুলাে বাছতে থাকে। তিন-চারটে তুলে নিয়ে একজন জিজ্ঞেস করে, তুমকো নাম কেয়া?

ও বিগলিত হেসে উত্তর দেয়, কাকতাড়ুয়া।

কেয়া বাত? কাক… বাকিটুকু আর উচ্চারণ করতে পারে না। হেসে গড়িয়ে পড়ে সবাই। একজন ওর পিঠ চাপড়ে দেয়। ও ওদের পাশে পা ছড়িয়ে বসে চারদিকে দেখতে থাকে। ক্যাম্পের প্রতিটি জায়গা ও ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে পরিমাপ করে। লােকগুলাে বেশ মনােযােগ দিয়ে পেয়ারা খাচ্ছে। রােদে-গরমে ওদের গাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। ওর হাসি পায়। হা-হা করে হাসতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আহাদ মুন্সি ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, এই বেয়াদব, হাসছিস কেন?

লােহার টুপি কি মানুষের মগজ খায়?

কী বললি? আহাদ মুন্সি ভুরু কুঁচকে তাকায়।

ও আবার একই কথা বলে। আহাদ মুন্সির চোখ লাল হয়ে ওঠে।

সেদিনও তুই আমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছিলি। আজও করলি। তাের নাম কী?

কাকতাড়ুয়া।

কাকতাড়ুয়া! ঠিক করে বল?

কাকতাড়ুয়া।

বলতে বলতে ও হেসে গড়িয়ে পড়ে। তারপর সুর করে বলতে থাকে, লােহার টুপি মানুষ খায়, মানুষ খায়…।

আহাদ মুন্সি চেঁচিয়ে ওঠে, পাগল না ছাই। আস্ত বদমাশ একটা। এই, ওকে কাকতাড়ুয়া বানিয়ে রাখ।

আহাদ মুন্সির সঙ্গে তিনজন রাজাকার ছিল। ওরা খুব মজা পায়। শক্ত করে দুহাত চেপে ধরে দু-চারটে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, আর বদমাশি করবি তাে জানে মেরে ফেলব। ঘুঘু দেখেছ, কিন্তু ফাদ দেখনি, চাঁদ।

ওরা ওকে কাকতাড়ুয়া বানানাের উৎসবে মেতে ওঠে। হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় মাঠের মাঝখানে। ও এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন? আমি তাে হেঁটে যেতে পারি । ভয় পেয়ে আমি পালাই না।

ইস, বড় বড় কথা।

বলবে না। বাপ-মা-ভাইবােন সব তো খেয়েছে।

খবরদার বাজে কথা বলবে না।

ইস, নৰাৰ। নৰাব হয়েছে ! মার এক থাপ্পড়।

মারাে না মেরেই ফেল। লােকে জানুক যে আমি স্বাধীনতার যুদ্ধে শহিদ হয়েছি।

কী বললি?

যা বলেছি তা তাে দুকান দিয়ে শুনেছই। আবার কী?

তখন একজন ওর গালে ঠাস করে চড় মারে। ও রুখে দাঁড়িয়ে বলে, আমি শােধ নিতে জানি।

আবার কথা।

দুজনে ওর দুহাত চেপে ধরে। অন্য জন পা ধরে চ্যাংদোলা করে নেয়। ও বলে, তিনজনে মিলে একজনকে মারছ লজ্জা করে না?

লজ্জা কিসের? মেরে ভূত করে ফেলব। তখন বুঝবি। আজ ছেড়ে দিলাম। বাপ-মা মরা ছেলে বলে রেহাই পেলি। ওরা ওকে মাঠের মাঝখানে এনে ধাম করে ফেলে দেয়। ও নড়েচড়ে না। উঠে দাড়ায় না। চিত হয়ে শুয়েই থাকে। চোখ বােজা। ওরা মাঠের মাঝখানে একটি বাঁশ পুঁতে বাঁশের সঙ্গে শরীরটা বাধে। আর একটি বাঁশের ওপর রাখে ওর ডান হাত। অন্যটিতে বা হাত। ওর গায়ের জামাটা বেঁধে দেয় মাথায়। তারপর রান্নাঘর থেকে হাঁড়ির নিচের কালি এনে মুখে লাগায়। বুক-পিঠও আঁকাবাঁকা রেখায় ভরিয়ে দেয়। তারপর হি হি করে হাসতে হাসতে তিনজন রাজাকার চলে গেলে ওর চোখ জ্বলে ওঠে। কাঠফাটা রােদের দারুণ গরমে সেপাইগুলাে দেখতে পায় ওর জ্বলে ওঠা চোখ। কিন্তু ওরা সে চোখের ভাষা বুঝতে পারে না। ভাবে, রােদে ছেলেটির খুব কষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া একটু আগে ওর দেওয়া পেয়ারা খেয়ে ওদের খুব মায়া হয়েছে। ওরা ওর নতুন ভঙ্গি দেখে। এভাবে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়,এটা ওদের ধারণায় নেই। ওরা জানে গুলি করতে, জানে যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলতে। তাই শান্তির এই নতুন ঢংটায় ওরা মজাই পায়। অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখে। পেয়ারা খাওয়ার কৃতজ্ঞতায় ওর শাস্তি মওকুফ করে দেওয়ার কথা ওদের মনেই আসে না। ছেলেটির ভাষায়, লােহার টুপি ওদের মগজ খেয়েছে। সন্ধ্যার সময় ওরা ছেলেটির বাধন খুলে দিয়ে বলে, ভাগ হিয়াসে।।

ও ভাগে না। ওরা যেভাবে ভাগতে বলেছে, তার মানে উধ্বশ্বাসে দৌড়ে পেরিয়ে যেতে হবে ক্যাম্পের সামনের মাঠটি। সেটা ও করতে পারবে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এখানে ওকে আবার ফিরে আসতে হবে। ও খুব শান্ত পায়ে হেঁটে মাঠটা পার হয়। হাঁটতে কষ্ট হয়। মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু শরীরের কষ্টটা তেমন নয়, ভেতরে সুখের পুঁটিমাছ রুপালি ঝিলিক তুলে সাঁতরায়। কত দিন আগে জেলেদের নৌকায় মাছ ধরতে গেলে জালভরা রুপালি পুঁটি দেখে ওর এমন আনন্দ হয়েছিল। কী আশ্চর্য, কোনাে কোনাে দৃশ্য কখনাে মুছে যায় না। কোনাে কোনাে দৃশ্য অন্য আরেকটি ঘটনার রেশ ধরে হুবহু তেমন আনন্দ বা দুঃখ তৈরি করে। ও বুঝে যায়, আজ রাতে ওর পােড়া ঘরে একটি মশাল তৈরি হবে। সেটি পুড়িয়ে দেবে আহাদ মুন্সির নতুন ভােলা ছনের ঘর ।।

পরদিন সকালে সেই তিন রাজাকার যখন ওকে খুঁজতে আসে, দেখতে পায় প্রবল জ্বলে ও কোকাচ্ছে। মা, মা বলে চিৎকার করছে। পানি খেতে চাইছে। খড়ের বিছনায় গড়াচ্ছে বলে খড়ের কুটো লেগে যাচ্ছে ওর গায়ে। ওকে ভয়ানক জীবের মতাে লাগছে। কিম্ভুতকিমাকার। ওর পাশে কেউ নেই। নেড়ি কুকুরটা মাচানের নিচে চিত হয়ে শুয়ে আছে । চারদিকে সুনসান। ওদের ভয় করে। ওরা ওকে ডাকতে সাহস পায় না। ভাবে, একে ডাকলে ওর ভূতটা ওদের কাধে লাফিয়ে চড়বে। মেরেও ফেলতে পারে ওদের। ওরা দ্রুত পায়ে পালিয়ে যায়। একজন বলে, ছেলেটি শুধু পাগল নয়, আজ ওকে একদম ভূতের মতাে লাগছে। কালি মাখানাে মুখটা দেখে আমার গা ছমছম করছিল।

ঠিক বলেছিস। আমারও ভয় করছিল। তা ছাড়া ছেলেটা কেমন করে যে কথা বলে। শুনলে গা হিম হয়ে যায়। আমার গায়ে কাঁপুনি ওঠে।

ওই ভূতটার তত জ্বর। তা হলে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুন দিল কে? আরেকজন রাজাকারের প্রশ্ন। ওর চেহারায়ও ভয়ের চিহ্ন। তিনজনে ভয়ে কাবু হয়ে গেছে।

অন্যজন বলে, রাতের বেলা নিশ্চয় মুক্তিবাহিনীর কেউ আসে। আমি এখন বুঝে গেছি। আমাদের আরও জোরদার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঠিক বলেছিস। আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমরা আরও সতর্ক না হলে মুক্তিবাহিনী আমাদের মেরে ফেলবে। দিন দিন ওদের দাপট বাড়ছে।

আমার মনে হয় বুধারও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ আছে।।

আরে ধুরাে, ওইটুকু ছেলেকে কে পাত্তা দেবে । ও কি বন্দুক চালাতে জানে? নাকি গ্রেনেডের পিন খুলতে শিখেছে?

শুনলি না সেদিন কীভাবে শহিদ হওয়ার কথা বলল।

বাপ-মা নাই ভাে এ জন্য মরণে ভয় নাই। পাগল।

আমার মনে হয় না ছেলেটা অত পাগল।

জ্বর হয়েছে। পাশে তাে কেউই নাই। দেখিস আজ রাতে ওটা মরবে। জ্যান্ত থাকতেই তাে ও ভূত হয়েছে।

ঠিক বলেছিস। তিনজনে হা-হা করে হাসতে হাসতে কত পায়ে হেঁটে চলে যায়। দুদিন পর গভীর রাতে একজন ওকে ফিসফিসিয়ে ডাকে, যুদ্ধ ও যুদ্ধ? জয় বাংলা? বঙ্গবন্ধু?

ও চমকে উঠে বসে। এত নামে ওকে ডাকলে ওর সব দুঃখ ধুয়ে যায়। যে নদী দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের নৌকা দ্রুত বেগে চলে যায়, সে নদীটা এমন একটা নামের নদী হয়। নদীর নাম যমুনা, করতােয়া, না পদ্মা, সেটা ও ভাবতে চায় না। ভাবে, নদীর নাম জয় বাংলা বা বঙ্গবন্ধু হলে ক্ষতি কী?

ও দুই লাফে উঠে বাইরে আসে।

কেমন আছিস মানিকরতন? ভালাে।

শাহাবুদ্দিন ভাই তুমি কেমন আছ?

তোর জ্বর ভালো হয়েছে রে?

ও হেসে ওঠে, ওটা তাে ভাল্লুকের জ্বর। যায় আর আসে। যুদ্ধের সময় কি জুরের কথা এত ভাবলে চলে?

না ভাবতে হবে। সুস্থ না থাকলে যুদ্ধ করবি কীভাবে? শরীরের তাে শক্তি চাই। ঠিক বলিনি?

 
বলেছ। তুমি ছবি আঁকার মানুষ। তুমি তাে ঠিকই বলবে। 
 
সেদিন তাের খুব কষ্ট হয়েছিল, না রে? 
 
যুদ্ধ করতে তােমাদের কি কষ্ট হয়?
 
তাে! কষ্ট হবে কেন? 
 
তাহলে আমার কষ্ট হবে কেন? 
 
শাৰাশ। 
 
এবার কী করতে হবে, বলাে। 
 
শুনেছি,ওরা একটা বাঙ্কার করবে। ক্যাম্পে বাঙ্কার করে ফেললে ওদের হারিয়ে দেওয়া কঠিন হবে। 
 
তার আগেই ক্যাম্পটা উড়িয়ে দিতে হবে। এই তাে? 
 
হ্যা। আমি একটা মাইন নিয়ে এসেছি। যেদিন বাঙ্কারটা বানাবে সেদিন তােকে মাটিকাটার দলের সঙ্গে কাজ করতে হবে। কাজ শেষ হলে যেভাবে তােক এই মাইনটা মাটির নিচে রেখে আসতে হবে। পারবি তাে?
 
এ আর এমন কী কঠিন কাজ। খুব পারব। 
 
সাবধান। 
 
হি-হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে ও। 
 
হাসছিস যে? 
 
হাসব না তাে কী! তােমার কথা শুনে তাে হাসি পায়। 
 
তুই কি জানিস, সাবধানে থাকাটা মুক্তিযুদ্ধের কৌশল? 
 
জানি । আচ্ছা বলাে তাে ওরা বাঙ্কার করবে কেন? 
 
ওরা বুঝতে পেরেছে যে নদীপথে এসে আমরা আক্রমণ করতে পারি। তা এমন সতর্ক ব্যবস্থা । 
 
ও আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাসতে হাসতে ওর পেটে খিল ধরে। ওর হাসির শব্দে শাহাবুদ্দিন ভয় পায়। মনে হয়, ছেলেটা বেশি সাহস করছে। শাহাবুদ্দিন তখনই সিদ্ধান্ত নেয় যে, দেশ স্বাধীন হলে ও ছেলেটির একটি ছবি আঁকবে। একটি নয়, অনেকগুলাে। যুদ্ধরত ছেলেটির নানা ভঙ্গির ছবি। 
 
যুদ্ধ, এমন করে হাসিস না রে। 
 
তুমি আমাকে হাসতে মানা করাে না। তুমি চলে গেলে আমি একাই হাসব। 
 
একা একা হাসিস না। তুই আমার সামনে বসে হাসবি। আমি তাের একটি ছবি আঁকব। সাহসী ছেলের ছবি। 
 
তুমি আর এখানে বেশিক্ষণ থেকো না, শাহাবুদ্দিন ভাই। 
 
শােন, পরশু দিন সন্ধ্যায় আমি নৌকা নিয়ে তৈরি থাকব। ক্যাম্পটা যখন মাইন ফেটে হাউইবাজির মতাে ছিটকে উঠবে, তখন আমরা নদীপথে সরে পড়ব। 
 
ছেলেটি আবার হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, ভারি মজার খেলা। 
 
যাই রে, জয় বাংলা। 
 
এসাে। সাবধান। আবার দেখা হবে। 
 
শাহাবুদ্দিন অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ছেলেটি মাচার ওপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। বাকি রাত ওর আর ঘুম আসে না।
 
পরদিন ও ক্যাম্পে যাওয়ার পথের ধারে বসে থাকে। কখন মাটি কাটার দল আসবে? ও ঘােরাফেরা করে। ফড়িং ধরে। ঘাসের কচি ডাটা চিবােয়। ডােবা থেকে পানি তুলে খায়। কিন্তু সেদিন মাটি কাটার দল আর আসে না। দুপুরের পর রােদ কমে গেলে ও গুটিগুটি পায়ে মিঠুদের বাড়িতে হাজির হয়। রান্নাঘরের বারান্দায় পা গুটিয়ে বসে বলে, খালা, আমার খিদে পেয়েছে। সারা দিন খাইনি। 
 
তােকে কত বলি রােজ এসে ভাত খেয়ে যাবি। কেন যে তুই আসিস না। আমার সামনে বসে তােকে ভাত খেতে দেখলে আমার কষ্ট কমে যায়। বুকের শূন্য জায়গাটা ভরে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি দেশটা স্বাধীন হলাে। 
 
ও মৃদু হাসে। মিঠুর মা ওকে সানকিভরা ভাত দেয়। সঙ্গে বেগুন দিয়ে ট্যাংরা মাছের তরকারি। উহ্ কী মজা, কী আনন্দ! ও হাপুস-হুপুস খায়। মিঠুর মা দেখতে পায় ওর চোখে তারার আলাের ফুলকি। বলে, ছন্নছাড়া, আমার মধুকে তাে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলল। মিঠুও বাড়ি ছেড়েছে। মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে থাকে। তােকে পেলে তাের খালু আর আমি দুঃখ ভুলব। এখন থেকে তােকে আমি মধু বলে ডাকব, কেমন? 
 
ও একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, শুধু মধু না, শহিদ মধু। 
 
শহিদ মধু? ও আমার মধু রে… বলে মিঠুর মা কাঁদতে শুরু করে। এ শুধু কান্না নয়, একে বলে গগনবিদারী চিঙ্কার। যাদের ছেলেরা শহিদ হয় – এ চিৎকার শুধু তাদের বুক ফুটো করে বেরিয়ে আসে। আর কারও কণ্ঠ এমন ধ্বনি ওঠাতে পারে না। ওর আর ভাত খাওয়া হয় না । ও থালা নিয়ে উঠে আসে। ঘরের পেছনে এসে ভালাে ছিটিয়ে দেয়। কাকেরা উড়ে আসে। 
 
ভাতের দানা তুলে নিতে থাকে ঠোটে। ও নিজেকে বলে, কী সুন্দর দৃশ্য। কাকেরা ভাত খেলে শহিদের মায়েদের বুক জুড়ায় ! দেশ থেকে বর্গি পাল্লায় । শহিদের মায়েরা কাকেদের ডানায় ভর করে উড়াল দিতে থাকে স্বাধীনতার খবর হাটে-ঘাটে-বাটে পৌছে দেওয়ার জন্য। ও আবারও বলে, কী সুন্দর দৃশ্য। যখন ও পুকুরের ঘাটে বসে সানকিটা ধুয়ে নেয়,তখন বুঝতে পারে খালার কান্না থেমেছে এবং খালা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে। 
 
পুকুরঘাট থেকে ফিরে এসে ও আস্তে করে বলে, যাই খালা। 
 
তুই আবার কবে আসবি? 
 
জানি না। অনেক কাজ। 
 
রােজ রােজ এসে ভাতটা তাে খেয়ে যেতে পারিস। 
 
অনেক কাজ। আচ্ছা।। 
 
বিড়বিড় করে বলে ও ঘাড় কাত করে। মিঠর মা জানে, ও আসবে না। তার বুক ভারী হয়ে ওঠে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। যেন কিছুক্ষণ আগে মিলিটারির ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছে মধু। গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া লাশটা আনা হয়েছে ওর মায়ের সামনে। মায়েরাই তাে এমন। বুক উজাড় করে কাদে। সে কান্নায় পাখি গাছের ডালের বসে ডাকতে ভুলে যায়। সুব্ধ হয়ে থাকে ঘাসফড়িং! নিভে যায় জোছনার আলাে। মায়েদের কান্না সইতে পারে না কেউ। ভাবতে ভাবতে ওর চোখ ভিজে ওঠে। 
 
পথে দেখা হয় কুন্তির সঙ্গে। ও একগাদা শাপলা তুলে বাড়ি যাচ্ছে। বুধাকে দেখে চকচক করে ওঠে ওর দৃষ্টি। বলে, কত দিন তুমি আমাদের বাড়িতে আসাে না, বুধা ভাই। 
 
সময় পাই না রে! অনেক কাজ। 
কী এত কাজ? আমাকে দেখতে তােমার ইচ্ছে হয় না? আমার ভীষণ ইচ্ছে হয় তােমাকে দেখার। কত দিন বাজারে গেলাম, কিন্তু তােমার দেখা পেলাম না। 
 
আমার অনেক কাজ, কুন্তি। ও কুন্তি শক্ত কণ্ঠে বলে, আমি জানি তােমার অনেক কাজ। আমিও তােমার সঙ্গে যুদ্ধ করব। 
 
যুদ্ধ করবি?
 
না তাে কী? করবই তো। তুমি শুধু বলবে, আমাকে কী করতে হবে। 
চল, বাবা-মায়ের কবরটা দেখে আসি। চলাে। তুমি তাে জানাে না, যে আমি চাচা-চাচির কবর পরিষ্কার করে রাখি। ঘাস সাফ করি। শুকনাে পাতা উঠিয়ে ফেলে দিই। আমি প্রতিটি কবরের মাথায় একটি করে গাছ লাগিয়েছি। 
 
তুই এত কিছু করিস, কুন্তি?
 
করি তাে। 
 
কেন করিস? 
 
তুমি তা হলে খুশি থাকবে এ জন্য। 
 
কুন্তি। 
 
কুন্তির দুচোখে ঝিলিক। বুধা ওর হাত জুড়িয়ে ধরে। তারপর ওর হাত ধরে বাবা-মায়ের কবরের কাছে আসে। দেখতে পায় কুন্তি আকন্দ, ভাটফুল, ধুতরা—এসব গাছ লাগিয়েছে কবরের মাথায়। কী সম্পর দেখাচ্ছে কবরগুলাে। ও মায়ের কবরের সামনে বসে বলে, মা, তুমি আমাকে দোয়া করাে। তােমার ছেলের মাথায় অনেক কাজ। সামনে অনেক কাজ করতে হবে। যদি তােমার সঙ্গে এখানে বসে আর কথা বলতে না পারি 
 
কুন্তি গলা উঁচু করে বলে, এসব কী কথা বলছ, বুধা ভাই। তুমি কোথায় যাবে? 
 
যাব না, যেতে পারি।
 
কোথায়? 
 
আকাশে। 
 
আকাশে কেন?
 
যদি ওই সৈনিকগুলাে আমাকে মেরে ফেলে। যদি ওদের গুলিতে আমার বুক ফুটো হয়ে যায়। 
 
ওহু আল্লাহ রে…। কুন্তি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। 
 
কাঁদিস না। থাম। আমি তাে জানি তুই ছাড়া আমার আর আপন কেউ নাই। তুই কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়। 
 
কুন্তি কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে বলে, ছাই হয়। 
 
বুধা ওর মাথায় চাটি মেরে আবার বাবার কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, তােমার ছেলে যেন তার আনন্দের দিনগুলাে ফিরে পায়, বাবা। যেন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে। বাবা, তুমি আমাকে দোয়া করাে, যেন সাহস হারাই। হঠাৎ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে বুধা। অবাক হয় কুস্তি । ওকে কখন কাঁদতে দেখেনি। আজ কী হলাে? 
 
বুধার কান্না থামলে কুত্তি চোখ গরম করে বলে, তুমি যুদ্ধ করতে ভয় পাচ্ছ? কাঁদছ কেন? 
 
বুধা লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকে। কুন্তি তীব্র ভাষায় বলে, মরণের কথা মনে করলে যুদ্ধ করা যায় না। যুদ্ধ করলে মরতে তাে হবেই। 
 
কুন্তি ! তুই একটা খুব ভালাে মেয়ে। 
 
এই যে শাপলা তুলে এনেছি কে জানাে?
 
 খিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য । 
 
খিদে না মরণ। যুদ্ধ ছাড়াও মরণ থাকে। 
 
ছেলেটি অবাক হয়। কুন্তির আজ হলাে কী? কুন্তি যেন ধাম করে বড় হয়ে গেল। এক রাতে বড় হওয়ার মতাে জাদুর খেলা।
 

যাই বাড়িতে। মাকে এগুলাে দিলে মা রাঁধবে। তবেই না আমাদের খাওয়া হবে। তুমি অনেক দিন আমাদের বাড়িতে যাওনি। আজ চলাে।

হ্যাঁ চল । চাচিকে দেখে আসি ।

ও কুন্তির হাত ধরে হাঁটতে থাকে।

পরদিন ও দেখতে পায় মাটি কাটার দল ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। ও এক দৌড়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

ফজু চাচা, আমি আপনাদের সঙ্গে মাটি কাটৰ ।

পারবি? ওই তাে শরীর! তাের গায়ে কি বল আছে? যা, ভাগ।

কাজ না করলে খাব কী? আমার খিদে পায় না? আমার কি কেউ আছে?

ও ফুপিয়ে কেদে ওঠে। কান্নার এমন ধ্বনি তােলে যে অন্যরা থমকে যায়।

হয়েছে, হয়েছে, কাদতে হবে না।

সবাই মিলে ওকে সান্ত্বনা দেয়।

আয় আমাদের সঙ্গে। দলে থাকলে আহাদ মুন্সি তােকে না করতে পারবে না। ও দলে মিশে যায়। গামছায় পেঁচিয়ে মাইনটা কোমরের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছে। গায়ে ঢােলা জামা। বােঝাই যায় না যে ভেতরে কিছু আছে।

বাঙ্কার কাটা শুরু হয়েছে। সবাই ব্যস্ত। কোদালের কোপে উঠে আসছে মাটির ঢেলা। আহাদ মুন্সির ছেলে মতিউর কাজের তদারকি করছে। লােকজনকে ধমকি-ধামকি দিয়ে অস্থির করে তুলেছে।

বুধাকে দলে নেওয়ার জন্য ফজু মিয়াকে বকাবকি করে। কিন্তু একটু পরে কাজে ওর আগ্রহ দেখে খুশি হয়। দৌড়ে দৌড়ে মাটিভরা ঝুড়ি নিয়ে ও পুব দিকে ফেলে আসতে যায়। মাটি ঢেলে খালি ঝুড়ি নিয়ে আবার দাড়ায় ফজু মিয়ার সামনে। ওর এমন চটপটে কাজের ভঙ্গি দেখে মতিউর মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না। ভাবে, মা-বাবা মরে গিয়ে ছেলেটা বখে গেছে। নইলে একটা কিছু হতে পারত। দুপুর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি দেখে ও খুশিমনে ভাত খেতে বাড়ি যায়।

বিকেলের মধ্যে বাঙ্কারের কাজ শেষ। সবাই খুশি। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে পারবে। ফজু মিয়া মুখ-হাত ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবে, যা দিনকাল পড়েছে, সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে কি থাকা যায়! ঠুস করে একটা গুলি এসে যে বুক ফুটো করে দেবে। এই শুয়ােরের বাচ্চারা তাে পাখির মতাে মানুষ মারে।

সেই মুহুর্তে ছেলেটি ফজু মিয়াকে বলে, চাচা, আমি একবার ভেতরটা দেখে আসি? বাঙ্কার কেমন এ তাে আর এই জীবনে দেখা হবে না।

যাবি তাে যা। ভেতরে ঢুকে দেখে আয়। কিন্তু সাবধান, সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিৰ আমরা ।

ফজু মিয়ার কাছ থেকে বাড়ি ফেরার কথা কে শুনতে চায়, ওর পায়ে ক্ষিপ্র গতি! মুহুর্তের মধ্যে বাঙ্কারে ঢুকে দুহাতে কাঁচা মাটি সরিয়ে পুঁতে ফেলে মাইনটা। তারপর শিস বাজাতে বাজাতে উঠে আসে। ফজু মিয়া জিজ্ঞেস করে, কি রে, কেমন হয়েছে?

দারুণ! ঢুকলে আর উঠতে মন চায় না। দেখাে সেপাইগুলাে ওটার ভেতর থেকে আর উঠতে চাইবে না। ফজু মিয়া হাসতে হাসতে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, পাগল।

ছেলেটি চোখ নাচিয়ে বলে, রাতের বেলা ওরা বাঙ্কারে শুয়ে হাউইবাজি দেখৰে। আহা রে আমি যদি এই বাঙ্কারে থাকতে পারতাম।

ফজু মিয়া ওকে এক পাশে টেনে ফিসফিসিয়ে বলে, আল্লাহ্ মাফ করুক। এখানে থাকার ভাগ্য যেন আমাদের না হয়। এটা হলাে ওদের কবর।

ও ফজু মিয়ার পা ধরে সালাম করে ভো দৌড় দেয়। কেন ও সালাম করল, কেন ও দৌড়াচ্ছে ফজু মিয়া বুঝতে পারে । বােঝে, বেলা পড়ে আসবে। ওকে বাড়ি ফিরতে হবে ।

ছেলেটি দৌড়াতে দৌড়াতে নদীর ধারে আসে। সন্ধ্যার আঁধার হয়েছে । ঝােপের ধারে লুকিয়ে থাকা শাহাবুদ্দিনের কাছে পৌছে যায় ও। শাহাবুদ্দিন ওকে জড়িয়ে ধরে, তাের জন্য উৎকণ্ঠায় আমি প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ।

পুঁতে রেখে এসেছি। কোনাে ভুল হয়নি। এখন শব্দটা শােনার জন্য বসে থাকব।।

শাবাশ ছেলে। নে, মুড়ি খা ।

দুজনে মিলে গুড়-মুড়ি খায়। পেঠ ভরলে আঁজলাভরা নদীর পানিতে তিয়াষ মেটায়। শাহাবুদ্দিন বলে, বাঙ্কারকে সহজ করলে কী হয়, বল তাে?

বাকার।

আর একটু ছােট করলে?

বার।

আর একটু ছােট

বক্কর। এবার মাঝখানের অক্ষরটাকে সামনে নিয়ে আয়।

কবর।

ও উত্তেজিত হয়ে বলে, বৰ্কর, বর; কবর, কবর। শাহাবুদ্দিন ভাই ওদের কবর।

সেই মুহুর্তে কয়েকজন সেপাই বাঙ্কারে পজিশন নেওয়ার জন্য ঢুকলে পায়ের চাপে বিস্ফোরিত হয় মাইন। প্রচণ্ড শব্দ ছড়িয়ে পড়ে গায়ে, সেই সঙ্গে আর্তচিৎকার। শাহাবুদ্দিন ছেলেটির হাত ধরে লাফিয়ে নৌকায় ওঠে। ক্যাম্পের উল্টোদিকে ছুটে যায় নৌকা। দক্ষ মাঝি এক টানে অনেক দূরে চলে আসে। সন্ধ্যার অন্ধকার চারদিকে। আকাশে ফুটিফুটি তারা।

ছেলেটি নৌকার পাটাতনে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। দুহাত দুদিকে লম্বা করে মেলে দিয়েছে। কখন যে গায়ের জামাটি খুলে মাথায় বেঁধেছে,শাহাবুদ্দিন তা খেয়াল করেনি। ঠিক চড়য়া সেজে থাকার ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। শাহাবুদ্দিন যখন বুঝতে পেরেছে যে ওরা বিপদসীমা পার হয়ে এসেছে, তখন থেকেই ওর ভীষণ গান গাইতে ইচ্ছে করছিল । মনে মনে সুর ভাজে। গলা খুলে গাইবার আগেই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় ও চোখের পলক পড়ে না। চারদিকের মাঠ, বাড়ি, ধানখেত, নদী, আকাশ গাছগাছালিজুড়ে ছেলেটি এক আশ্চর্য বীর কাকতাড়ুয়া। রুখে দিচ্ছে শত্রুর গতি। বুকের ভেতর ধরে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধ।
 

অনুশীলনী 

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন 

১। বুধার কয় ভাইবােন কলেরায় মারা যায়? 

ক. ৩ জন

খ, ৪ জন

গ. ৫ জন 

ঘ. ৬ জন

২। চঞ্চু কথার অর্থ কী? 

ক. পা

খ. পাখা

গ. ঠোট 

ঘ. কান

৩। হরিকাকুর সঙ্গে বুধার কোথায় দেখা হয়েছিল? 

ক. জামতলায়

খ. ফসলের মাঠে 

গ. বাজারে

ঘ. রাস্তায়

৪। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিল কে? 

ক. মতিউর 

খ. আহাদ মুন্সি 

গ. হাশেম মিয়া

ঘ. হরিবাবু 

৫। নিজের বােঝা নিজে বইব। বুধার এ বক্তব্যে ফুটে ওঠে — 

ক. সাহস 

খ. আত্মবিশ্বাস 

গ. স্বনির্ভরতা

ঘ. দেশপ্রেম 

৬। বিদেশি মানুষ এবং নিজেদের মানুষ সবার ওপর বুধার ঘৃণা বাড়তে থাকে কেন? 

ক. যুদ্ধ করার জন্য

খ. অত্যাচার করার জন্য 

গ. বিরােধিতা করার জন্য

ঘ. গণহত্যার জন্য 

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৭ ও ৮নং প্রশ্নের উত্তর দাও।

‘কবর’ নাটকে বর্ণিত ইন্সপেক্টর হাফিজ ভাই শহিদদের একটা গণকবরে মাটি চাপা দিতে চাইলে গােরখুড়েরা আপত্তি জানায়। তাদের বক্তব্য, মুসলমানের লাশ দাফন নাই, কাফন নাই তার ওপর আলাদা একটা কবর পাবে না তা হতে পারে না কভি নেহি। 

৭। উদ্দীপকের গোরখুঁড়েদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ চরিত্রটি হলাে— 

ক. আহাদ মুন্সি

খ. মতিউর

গ. বুধা

ঘ. কুন্দুস 

৮। এরূপ সাদৃশ্যের কারণ হলাে— 

ক. দেশপ্রেম

খ. প্রতিবাদী মনােভাব 

গ. সচেতনতা 

ঘ. প্রতিশােধ স্পৃহা 

৯। আমরা লড়াই না করলে গ্রামটা একদিন ভূতের বাড়ি হবে’ । কেন ভূতের বাড়ি হবে?

  1. গণহত্যার কারণে 
  2. লােকজন পালিয়ে যাওয়ায়
  3. গ্রামটি জনশূন্য হওয়ায় 

কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii 

খ. i ও iii 

গ. ii ও iii 

ঘ. i, ii ও iii 

১০। যুদ্ধে শত্রুরা কখন হেরে যায়? 

ক. সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে

খ. আধুনিক অস্ত্র থাকলে 

গ. উন্নত প্রশিক্ষণ থাকলে

ঘ. সৈন্যসংখ্যা বেশি হলে

কাকতাড়ুয়া উপন্যাসের mcq

 

উপন্যাস গদ্যে লেখা এক ধরনের কী?
ক. কাহিনি
খ. শোকগাথা
গ. কবিতা
ঘ. গল্প

উমবার্তো একো কোন দেশের অধিবাসী?
ক. ফ্রান্স
খ. ইতালি
গ. আমেরিকা
ঘ. রাশিয়া

ale অর্থ কী?
ক. শ্লোক
খ. গল্প
গ. উপন্যাস
ঘ. গীতিকবিতা

উপন্যাসের চর্চা হয়-
ক. প্রায় চারশ বছর
খ. প্রায় আড়াইশ বছর
গ. প্রায় তিনশ বছর
ঘ. প্রায় একশ বছর

সাধারণভাবে উপন্যাস কয়টি উপাদানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে?
ক. ৩
খ. ৪
গ. ৫
ঘ. ৬

আখ্যানভাগ অর্থ কী?
ক. কাহিনি-সমগ্র
খ. সংলাপ
গ. বর্ণনার ভঙ্গি
ঘ. চরিত্র নির্বাচন

বাংলা উপন্যাসের বয়স কত?
ক. একশ বছর
খ. দেড়শ বছর
গ. দুইশ বছর
ঘ. আড়াইশ বছর

মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে কোন শাসনের সূত্রপাত ঘটলে?
ক. ইংরেজ
খ. ব্রিটিশ
গ. জমিদার
ঘ. গণতান্ত্রিক

‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ কার রচনা?
ক. শরৎচন্দ্র
খ. রবীন্দ্রনাথ
গ. বঙ্কিমচন্দ্র
ঘ. বিভূতিভূষণ

সেলিনা হোসেন কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
ক. যশোর
খ. রংপুর
গ. রাজশাহী
ঘ. বরিশাল

কখন সেলিনা হোসেন লেখালেখি শুরু করেন?
ক. চল্লিশের দশকে
খ. পঞ্চাশের দশকে
গ. ষাটের দশক
ঘ. সত্তরের দশক

বড়দের জন্য প্রকাশিত সেলিনা হোসেনের উপন্যাস সংখ্যা কত?
ক. ত্রিশ
খ. বত্রিশ
গ. তেত্রিশ
ঘ. চল্লিশ

বাংলাদেশের মানুষ, তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কোন লেখকের লেখার জগৎ?
ক. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
খ. সেলিনা হোসেন
গ. হুমায়ুন আজাদ
ঘ. জহির রায়হান

‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সেলিনা হোসেনের কী ধরনের রচনা?
ক. প্রবন্ধ
খ. ছোটগল্প
গ. নাটক
ঘ. উপন্যাস

‘সুরমা চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ সেলিনা হোসেন কোথা থেকে পান?
ক. বাংলাদেশ
খ. ভারত
গ. আমেরিকা
ঘ. লন্ডন

কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেলিনা হোসেন সম্মান সূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত হন?
ক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খ. রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
গ. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
ঘ. দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়

কর্মজীবনে সেলিনা হোসেন কী ছিলেন?
ক. ডাক্তার
খ. সাংবাদিক
গ. বাংলা একাডেমির পরিচালক
ঘ. বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক

কার কাছে পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ সব সমান?
ক. কুন্তি
খ. আহাদ মুন্সি
গ. আতা ফুপু
ঘ. বুধা

বুধা ভাত মাংস পেট পুরে খেতে পায়-
ক. শুক্রবারে
খ. বিয়েবাড়িতে
গ. ঈদের দিন
ঘ. কুলখানিতে

রাত পোহাবার আগে চলে যায়-
ক. শিলু
খ. বিনু
গ. তিনু
ঘ. তালেব

বিনুর চোখ কেমন ছিল?
ক. ডাগর
খ. অপূর্ব
গ. কানা
ঘ. রক্ত ওঠা

বুধার কয় ভাইবোন কলেরায় মারা যায়?
ক. ৩ জন
খ. ৪ জন
গ. ৫ জন
.ঘ ৬ জন

সেবার কলেরায় মহামারীতে উজাড় হয়ে যায় গাঁয়ের-
ক. সব লোক
খ. এক-তৃতীয়াংশ লোক
গ. অর্ধেক লোক
ঘ. এক-চর্তুাংশ লোক

এক রাতে বুধা কত জন মানুষকে হারায়?
ক. ৫ জন
খ. ৬ জন
গ. ৭ জন
ঘ. ৮ জন

কে বুধার কাছে মুক্তি চায়?
ক. কুন্তি
খ. ফুলকলি
গ. মিঠু
ঘ. বুধার চাচি

কে বুধাকে সইতে পারেনি?
ক. মতিউর
খ. আহাদ মুন্সি
গ. মিঠু
ঘ. বুধার চাচি

কাকতাড়ুয়া সেজে কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে বুধার মাথায় কিসের ছায়া নেমে আসে?
ক. মেঘের ছায়া
খ. বিমানের ছায়া
গ. শকুনের ছায়া
ঘ. পাখির ছায়া

বাজারে আগুন লাগায়-
ক. আহাদ মুন্সি
খ. মিলিটারি
গ. ডাকাত
ঘ. অন্য গ্রামের লোক

পোড়া বাজারের দিকে তাকিয়ে বুধার-
ক. কাঁদতে ইচ্ছা করে
খ. প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা করে
গ. দুঃখ হয়
ঘ. চোখ লাল হয়

মিলিটারি আসার পরদিন গাঁয়ের মানুষ কী করে?
ক. পালাতে থাকে
খ. মিছিল করে
গ. মুক্তিবাহিনী গঠন করে
ঘ. রাজাকার হয়ে যায়

হরিকাকুর সঙ্গে বুধার কোথায় দেখা হয়েছিল?
ক. জামতলায়
খ. ফসলের মাঠে
গ. বাজারে
ঘ. রাস্তায়

বুধার মতে যে পালায়- সে কী?
ক. খারাপ
খ. বুদ্ধিমান
গ. ভিতুর ডিম
ঘ. হাঁদারাম

মিলিটারি প্রথমবার আসার কত মাস পর দ্বিতীয়বার আসে?
ক. এক মাস
খ. দেড় মাস
গ. দুই মাস
ঘ. আড়াই মাস

দ্বিতীয়বার এসে মিলিটারি গ্রামে কী বানায়?
ক. ক্যাম্প
খ. মসজিদ
গ. বাজার
ঘ. বাঙ্কার

গাঁয়ে মোট কতবার মৃত্যুর উৎপাত ঘটেছে?
শ. দুই বার
খ. তিন বার
গ. চার বার
ঘ. পাঁচ বার

চোখ লাল হলে বুধার ভেতরে কী জাগে?
ক. কান্নাবার আবেগ
খ. স্মৃতিকাতরতা
গ. কিছু করার ইচ্ছা
ঘ. ঘৃণা

অনেক রাতে কিসের শব্দে বুধার ঘুম ভাঙে?
. কুকুরের ডাকে
খ. আগুনের তাপে
গ. মানুষের চিৎকারে
ঘ. গুলির শব্দে

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কত তারিখে হয়েছে?
ক. ৭ মার্চ
খ. ২৬ মার্চ
গ. ২১ ফেব্রুয়ারি
ঘ. ১৬ ডিসেম্বর

যুদ্ধের কত বছর আগে বুধা বাবা-মা-সবাইকে হারিয়েছে?
ক. এক বছর
খ. দুই বছর
গ. তিন বছর
ঘ. চার বছর

কারা খায় দায়, ফুর্তি করে আর মানুষ ধরে নিয়ে যায়?
ক. মুক্তিযোদ্ধারা
খ. হানাদাররা
গ. গ্রামের লোকজন
ঘ. রাজাকাররা

শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিল কে?
ক. মতিউর
খ. আহাদ মুন্সি
গ. হাশেম মিয়া
ঘ. হরিবাবু

বিদেশি মানুষ এবং নিজেদের মানুষ সবার ওপর বুধার ঘৃণা বাড়তে থাকে কেন?
ক. যুদ্ধ করার জন্য
খ. অত্যাচার করার জন্য
গ. বিরোধিতা করার জন্য
ঘ. গণহত্যার জন্য

গাঁয়ের মানুষ কত ভাগে ভাগ হয়ে গেছে?
ক. দুই ভাগে
খ. তিন ভাগে
গ. চার ভাগে
ঘ. পাঁচ ভাগে

লড়াই না করলে গ্রাম কিসের বাড়ি হয়ে যাবে?
ক. পরির বাড়ি
খ. রাজাকারের বাড়ি
গ. জিনের বাড়ি
ঘ. ভূতের বাড়ি

যুদ্ধে শত্রুরা কখন হেরে যায়?
ক. সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে
খ. আধুনিক অস্ত্র থাকলে
গ. উন্নত প্রশিক্ষণ থাকলে
ঘ. সৈন্যসংখ্যা বেশি হলে

আহাদ মুন্সির ঘর কয় চালা?
ক. দোচালা
খ. চার চালা
গ. ছয় চালা
ঘ. আট চালা

কীভাবে বুধা আলির তেলের দাম শোধ করবে?
ক. গায়ে খেটে
খ. টাকা দিয়ে
. ফল দিয়ে
ঘ. ধান দিয়ে

মিঠু আর আলির মতে বুধা কেরোসিন তেল দিয়ে-
ক. বাতি জ্বালাবে
খ. ঘরের কাঠে দেবে
গ. ভালো কিছু করবে
ঘ. অন্যায় কাজ করবে

আগুন লাগায় ঘুমন্ত মানুষগুলো কী নিয়ে বেরিয়ে আসতে ব্যস্ত?
ক. বন্দুক নিয়ে
খ. জীবন নিয়ে
গ. টাকা নিয়ে
ঘ. জামা কাপড় নিয়ে

আহাদ মুন্সির বড় ছেলের নাম কী?
ক. কুদ্দুস
খ. মিঠু
গ. মতিউর
ঘ. আলি

রাজাকার কমান্ডারের বাড়িতে কাজ করে কে?
ক. বুধা
খ. কুন্তি
গ. মিঠু
ঘ. ফুলকলি

বুধা ফুলকলিকে কী খেতে দিল?
ক. আম
খ. বিস্কুট
গ. জিলাপি
ঘ. ভাত

রাজাকার কমান্ডারের বাড়িতে কিছু ঘটলে কে বুধাকে জানিয়ে দেবে?
ক. কুন্তি
খ. মিঠু
গ. আলি
ঘ. ফুলকলি

কখন ফুলকলির দুঃখ থাকবে না?
ক. নতুন চাকরি পেলে
খ. রাজাকার কমান্ডার মারা গেলে
গ. বুধা বড় হলে
ঘ. দেশ স্বাধীন হলে

স্বপ্নের আশ্চর্য দেশে বুধা কাকে পাশে দেখতে পায়?
ক. কুন্তি
খ. মিঠু
গ. ফুলকলি
ঘ. আলি

‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসে উল্লিখিত শাহাবুদ্দিন কোথায় পড়ে?
ক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
খ. ঢাকা কলেজে
গ. আর্ট কলেজে
ঘ. হাই স্কুলে

শাহাবুদ্দিনের মতে গ্রামে কে একাই লড়াই করছে?
ক. আলি
খ. মিঠু
গ. বুধা
ঘ. আহাদ মুন্সি

কখন বুধার মা ভাপা পিঠা বানাত?
ক. গ্রীষ্মকালে
খ. বর্ষাকালে
গ. শীতকালে
ঘ. শরৎকালে

“কেয়ামতের দিন মাথার এক হাত উপরে সূর্য নেমে আসবে।” কার কথা?
ক. শিক্ষকের
খ. মৌলবির
গ. আহাদ মুন্সির
ঘ. বুধার বাবার

পাকিস্তানি সেনাদের কাছে বুধা তার নাম কী বলে?
ক. বুধা
খ. বঙ্গবন্ধু
গ. যুদ্ধ
ঘ. কাকতাড়ুয়া

বেয়নেট দিয়ে মানুষ মারতে কারা মজা পায়?
ক. মিলিটারিরা
খ. রাজাকাররা
. মুক্তিযোদ্ধারা
ঘ. গ্রামবাসী

মাঠে বুধাকে কাকতাড়ুয়া সাজানোর পর কখন সে ছাড়া পায়?
ক. দুপুরে
খ. বিকেলে
গ. সন্ধ্যায়
ঘ. রাতে

কখন শাহাবুদ্দিন বুধার ছবি আঁকবে?
ক. বুধা মারা গেলে
খ. দেশ স্বাধীন হলে
গ. বুধা অসুস্থ হলে
ঘ. শাহাবুদ্দিন ছুটি পেলে

কুন্তি শাপলা তুলেছে কেন?
ক. ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচার জন্য
খ. বিক্রির জন্য
গ. ফুলের মালা বানানোর জন্য
ঘ. গরুকে খাওয়ানোর জন্য

মাটি কাটার আবদার নিয়ে বুধা কার কাছে যায়?
ক. আহাদ মুন্সির
খ. মিলিটারির
গ. ফজু মিয়ার
ঘ. মতিউরের

‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসে উল্লিখিত ফজু মিয়ার মতে বাঙ্কার কী?
ক. ভালো ঘর
খ. লুকিয়ে থাকার স্থান
গ. কবর
ঘ. গুদামঘর

বাঙ্কার তৈরির কাজে অগ্রগতি দেখে কে প্রশংসা করে?
ক. মিলিটারি
খ. আহাদ মুন্সি
গ. ফজু মিয়া
ঘ. মতিউর

ঝোপের ধারে লুকিয়ে থাকে-
ক. শাহাবুদ্দিন
খ. মিঠু
গ. আলি
ঘ. মতিউর

নৌকায় বুধা কিসের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে?
ক. অসুস্থ হওয়ার
গ. কাকতাড়ুয়ার
গ. মৃতের
ঘ. নিলডাউন

সৃজনশীল প্রশ্ন

১। পাকসেনারা থানায় ঘাটি স্থাপন করলে এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করে। সবাই পালাতে শুরু করলে কলিমদ্দি দফাদার ভিন্ন পরিকল্পনা করেন। তিনি পাকসেনাদের ঘায়েল করার জন্য তাদের সাথে যােগাযােগ শুরু করেন। আর গােপনে সব খবর পৌঁছে দেন, প্রস্তুত থাকতে বলেন। একদিন সুযােগমতাে পাক সেনাদের গ্রামে এনে ভাঙা পুলের গােড়ায় দাঁড় করিয়ে কলিমদ্দি দফাদার তা পার হতে গিয়ে পরিকল্পনামাফিক জলে পড়ে যান। সাথে সাথে গর্জে ওঠে ওৎ পেতে থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র। আর খতম হয় সব কজন। পাকসেনা। 

ক. বুধা প্রায়ই কী সাজত?

বুধা প্রায়ই কাকতাড়ুয়া সাজত।

খ. আধা-পােড়া বাজারটার দিকে তাকিয়ে ওর চোখ লাল হতে থাকে। কেন?

‘আধা-পোড়া বাজারটার দিকে তাকিয়ে ওর চোখ লাল হতে থাকে।” কারণ সেদিকে তাকিয়ে হানাদার বাহিনীর প্রতি বুধার ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহা বাড়তে থাকে। অন্যায় কিছু দেখলেই বুধার খুব রাগ হয়। আর রাগ হলে তার চোখ লাল হতে থাকে।

হানাদাররা হঠাৎ করে একদিন বুধাদের গ্রামে এলো। বাজারের অনেক মানুষকে গুলি করে মারলো। অবশেষে আগুন দিয়ে বাজারটা পুড়িয়ে দিল। তারা যাওয়ার পরে গ্রামের মানুষেরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করলো। বুধা নিজেও মাটির হাড়িতে করে ডোবা থেকে পানি নিয়ে আসে। পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতি ওর রাগ বাড়তে থাকে। ও মনে মনে ফুঁসতে থাকে। প্রতিশোধ নেয়ার কথা ওর মনের ভেতর ঢুপকঢাপ শব্দ তোলে। এক সময় আগুন নিভে গেলে আধা-পোড়া বাজারটার দিকে তাকিয়ে ওর চোখ লাল হতে থাকে।

গ. উদ্দীপকের কলিমদ্দি দফাদারের সাথে কাকতাড়ুয়া' উপন্যাসের সাদৃশ্যপূর্ণ চরিত্রটি ব্যাখ্যা করাে।

“কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে বুধা অত্যন্ত কৌশলী কিশোর। তার এ চরিত্রের সাথে উদ্দীপকের কলিমদ্দি দফাদারের সাদৃশ্য রয়েছে। শক্তি দিয়ে সবকিছু হয় না।

পৃথিবীতে শক্তির চেয়ে বুদ্ধির মূল্য অনেক বেশি। শক্তি দিয়ে যে কাজ সাধন করা অসম্ভব, বুদ্ধি দিয়ে সে কাজ করা খুবই সহজ। বুদ্ধিমত্তার কারণেই মানুষ পৃথিবীর সেরা জীব। যারা বোকা, তারা শক্তি দিয়ে সব কাজ সাধনের চেষ্টা করে।

উদ্দীপকে কলিমদ্দি দফাদারের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ পাওয়া ঘায়। পাকসেনার থানায় ঘাটি স্থাপন করে। ফলে এলাকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। সবাই পালাতে শুরু করে। তখন কলিমদ্দি দফাদার ভিন্ন পরিকল্পনা করেন। পাক হানাদারদের বুঝতে না দিয়ে তিনি তাদের দলের লোক হিসেবে অভিনয় করেন। এমন ভাব করেন, যেন মনে হয় তিনি রাজাকার দলে যোগ দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, গোপনে তিনি যোগাযোগ রাখেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। একদিন তিনি মিলিটারিদের ভাঙা পুলের সামনে নিয়ে আসেন। পুলে উঠে তিনি পানিতে ঝাঁপ দেন। আর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে পাকবাহিনী ধ্বংস হয়ে ঘায়। কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসেও এমন কৌশল লক্ষ্য করা যায় বুধার চরিত্রে। বুধা শ্রমিকদের সঙ্গে বাঙ্কার বানাতে যায়। বাঙ্কার তৈরি করা মানে হানাদারদের শক্তি বেড়ে যাওয়া। বুধা সবার শাহাবুদ্দিনের কথা মত সে বাঙ্কারের তলায় মাইন পুঁতে দিয়ে আসে। হানাদার বাঙ্কারে ঢুকে মাইনে পা দিতেই সব ধ্বংস হয়ে ঘায়। এভাবেই উদ্দীপকের কলিমদ্দি দফাদারের সাথে বুধার চরিত্রের মিল পাওয়া যায়।

ঘ. উদ্দীপকটি কাকতড়িয়া” উপন্যাসের সমগ্র ভাবকে ধারণ করে কি? যুক্তিসহ প্রমাণ করাে।

না, উদ্দীপকটি “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসের সমগ্র ভাবকে ধারণ করে না। কারণ উদ্দীপকের দিকটিই কাকতাড়ুয়া উপন্যাসের একমাত্র দিক নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এদেশের বুকে তা-ব চালিয়েছিল, অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছিল। তারা ভেবেছিল ংলার মানুষ ভিতু। অন্দ্রের মুখে এরা পিছু হটবে। বাঙালী তাদের চিন্তাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিল। বাঙালিরা মহা প্রতিরোধ গড়ে তোলে হানাদারের বিরুদ্ধে। অবশেষে ত্রিশ লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে অজিত হয় কাঙ্খিত স্বাধীনাতা। দেশপ্রেম। পাকসেনার থানায় ঘাটি স্থাপন করে। ফলে এলাকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। সবাই পালাতে শুরু করে। তখন কলিমদ্দি দফাদার ভিন্ন পরিকল্পনা করেন। পাক হানাদারদের বুঝতে না দিয়ে তিনি তাদের দলের লোক হিসেবে অভিনয় করেন।

এমন ভাব করেন, যেন মনে হয় তিনি রাজাকার দলে যোগ দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, গোপনে তিনি যোগাযোগ রাখেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। একদিন তিনি মিলিটারিদের ভাঙা পুলের সামনে নিয়ে আসেন। পুলে উঠে তিনি পানিতে ঝাঁপ দেন। আর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে পাকবাহিনী ধংস হয়ে যায়। “কাকতাড়ুয়া উপন্যাসেও এমন চরিত্রের খোঁজ পাওয়া ঘায়। সেই চরিত্রটির নাম হচ্ছে বুধা। সে পাগলের মত আচরণ করে, যাতে কেউ তাকে সন্দেহ করতে না পারে। সে রাজাকার কমান্ডার আর চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুন লাগায়। হানাদারদের খবর সংগ্রহ করে, কাজের সুযোগে বাঙ্কারে মাইন পুতে পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করে। কাকতাড়ুয়া উপন্যাসে বুধার পেয়েছে। রাজাকারদের তা-বে মানুষের জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠে। হানাদাররা বুধার গ্রামে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায়। জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পরে গ্রাম। অসংখ্য মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এছাড়াও বুধার প্রতি মানুষের ভীষণ ভালোবাসা ও বুধার কর্মঠ জীবন “কাকতাড়ুয়া, উপন্যাসে ফুটে উঠেছে যা উদ্দীপকে অনুপস্থিত। তাই বলা যায়, উদ্দীপকটি “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসের সমগ্র ভাবকে ধারণ করে না।

২। ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে গর্জে ওঠে কলেজপড়ুয়া আবু সাঈদ। আঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর নেতৃত্বে একের পর এক গেরিলা আক্রমণে অতিষ্ঠ পাকসেনারা। অপারেশন জ্যাকপটের সফল অভিযানের পর পাকসেনারা আবু সাঈদের গ্রামে আক্রমণ করে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। আর যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই নির্মমভাবে হত্যা করে। একসময় আবু সাঈদ জানতে পারে স্বজন হারানাের খবর। কিন্তু সে আপসহীন। তার একটাই প্রতিজ্ঞা,এ দেশের মাটি থেকে ওদের তাড়াতেই হবে। 

ক. কে বুধাকে ‘মানিকরতন' বলে ডাকত?

হরিকাকু বুধাকে “মানিকরতন” বলে ভাকতেন।

খ. ‘এবার মৃত্যুর উৎপাত শুরু করেছে ভিন্ন রকমের মানুষ। এ কথা বলার কারণ কী?

এবার মৃত্যুর উৎপাত শুরু করেছে ভিন্ন রকমের মানুষ।” “কাকতাড়ুয়া, উপন্যাসে এ কথাটি বলেছে বুধা, পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ প্রসঙ্গে। “কাকতাড়ুয়া উপন্যাসে বুধার মাধ্যমে কিশোর মানসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরা হয়েছে। কিশোর বুধার মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসার দিকটি এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। গ্রামে কলেরার আক্রমণে বুধার মা-বাবা, ভাইবোন সবাই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। সে সময় যে মৃত্যু বুধা দেখেছিল, তা ঘটেছিল একটি বিশেষ রোগের কারণে। আর যুদ্ধের সময়ে এখন যে মৃত্যু বুধা দেখছে তা ভিন্ন রকম মানুষের নির্মমতায় শুরু হয়েছে। বুধার চিরচেনা পথ ধরে গুলি ছুড়তে ছুড়তে জিপে করে পাকিস্তানী সেনারা তার গ্রামে প্রবেশ করে। বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। তাদের নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা প্রসঙ্গে বুধা এ মন্তব্যটি করে।

গ. উদ্দীপকে বর্ণিত কাহিনী কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসের যে বিশেষ দিকটির ইঙ্গিত করে তা ব্যাখ্যা করো।

উদ্দীপকের কাহিনী “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসের বুধার অমিত সাহস ও স্বদেশপ্রেমের দিকটি ইঙ্গিত করে। মাতৃভূমির প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকে। অনেক সময় সেই ভালোবাসা সাধারণ্যে প্রকাশ পায় না। দেশ যখন শত্রু “কবলিত হয়। আর তা প্রকাশ পায় বৈশাখি ঝড়ের মত। ১৯১ সালে পাকিস্তানি হানাদারের সামনেও বাঙালি এমনই ঝড়ের মত ঝাপিয়ে পড়েছিল। দেশকে শত্র“মুক্ত করেছিল প্রবল বীব্রমে। পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এঁতিহাসিক এই মারের ভাষণ শুনে তার মনে দেশকে শন্রু “মুক্ত ও স্বাধীন করার বাসনা জাগে। সেই লক্ষ্যে সে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। একের পর এক নেতৃত্ব দেয় গেরিলা আন্রমণের। সফলভাবে শেষ করে অপারেশন জ্যাকপট। পাকসেনারা আবু সাঈদের গ্রামে হামলা চালায়। বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়।

আর যাকে যেখানে পেয়েছে, তাকেই সেখানেই নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের এত অত্যাচারেও সে থামে না। বরং শপথ করে দেশকে শক্রু “মুক্ত করার। এ রকমের মানসিকতা “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসের বুধার মধ্যেও পাওয়া যায়। বুধা কিশোর। কেউ তাকে মুক্তিযোদ্ধ মনে করে না। এ সুযোগ সে পুরোপুরি কাজে লাগায়। রাজাকার কমান্ডার আর শান্তি কমিটির চেয়্যারম্যানের বাড়িতে সে আগুন দেয়। মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয় শত্র“র বাঙ্কার। দেশকে শত্র“মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা তার মনেও কাজ করে। এভাবেই উদ্দীপকের সাইদের মুক্তিযুদ্ধের কার্যন্রম “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসের বুধার দেশপ্রেমের দিকটি ইঙ্গিত করে।

ঘ. উদ্দীপকের আবু সাঈদ-এর মনােভাবই যেন কাকতাড়ুয়া' উপন্যাসের মূল বক্তব্য। যুক্তিসহ প্রমাণ করাে।

“কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে বুধার মাধ্যমে কিশোর মানসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরা হয়েছে। যা উদ্দীপকের আবু সাঈদের মানসিকতায়ও পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের আদেশে হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। তারা বাংলার বুকে চালায় তাণুব। নির্বিচারে হত্যা করে অসংখ্য মানুষ। মা-বোনের দেয়। বাংলার মানুষ মুখ বুজে এ অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেনি। যুদ্ধের মাধ্যমে এর উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। হানাদার পরাজিত করে অর্জন করেছে কাঙ্খিত স্বাধীনতা। উদ্দীপকে আবু সাঈদের সাহসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। সাঈদ কলেজে পড়ে। সে দেশকে শক্ত “মুক্ত করার শপথ নেয়।

সেই লক্ষ্যে সে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। একের পর এক নেতৃত্ব দেয় গেরিলা আক্রমণের। সফলভাবে শেষ করে অপারেশন জ্যাকপট। পাকসেনারা আবু সাঈদের গ্রামে হামলা চালায়। বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। আর যাকে যেখানে পেয়েছে, তাকেই সেখানেই নির্মমভাবে হত্যা করে। এক পর্যায়ে সে স্বজন হারানোর সংবাদ পায়। কিন্তু সে দমে যায় না। “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে বুধাও সমান সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। সে অনাথ কিশোর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে কৌশলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ । সবাই ভাবে বুধা পাগল। কিন্তু বুধা আসলে দেশের জন্য জীবন বাজি রাখতে সদা প্রস্তুত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে মূল বক্তব্য হল কিশোর মানসিকতায় দেশপ্রেম ও ত্যাগী মনোভাব। বুধা জীবনের প্রতি টান প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের কারণে তার ভেতর আবার জীবনবোধ জেগে ওঠে। দেশকে শন্রু “মুক্ত করার দারুণ নেশা তার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বারবার শত্রুর সাথে মরণখেলায় মেতে ওঠে। এই দেশত্মবোধই “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে মূল বিষয়। উদ্দীপকের আবু সাঈদের চরিত্রেও এই একই বিষয় প্রকটিত।

৩। জমিদার মফিজ খার নাম শুনলে প্রজারা ভয়ে কাঁপতে থাকে। তার হুকুমের অবাধ্য হলে সে প্রজার আর রক্ষা নেই। ইদানীং তার চেলা হিসেবে কাজ করছে হাসেম ব্যাপারি। সারাক্ষণ তাকে কুপরামর্শ দেয় আর নানা অজুহাতে প্রজাদের হালের বলদ, ঘরের টিন, পুকুরের মাছ ধরে নিয়ে আসে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে গ্রাম। ছাড়া করে। গ্রামের সালিস-বিচার সবই হাসেম ব্যাপারির ইঙ্গিতে চলে। তাই সাধারণ মানুষ কানাঘুষা করে হাসেম ব্যাপারি যেন জমিদারের জমিদার। 

ক. শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান কে ছিল?

শান্তি কমিটির চেয়্যারম্যান ছিল আহাদ মুন্সি।

খ. যে মানুষের দৃষ্টিতে ভাষা নেই, বুধার মতে সে মানুষ কেন মানুষ নয়?

যে মানুষের দৃষ্টিতে ভাষা নেই, সে মানুষকে বুধার মানুষ মনে না করার কারণ, বুধা প্রাণহীন মানুষকে মানুষই মনে করে না। কারণ, তারা দেশের শব্রু। বুধা পেয়ারা নিয়ে মিলিটারি ক্যাম্পে যায় তথ্য সংগ্রহ করতে। মিলিটারির খুব কাছাকাছি গেলেও তার ভয় লাগে না। অথচ এসব মিলিটারিই অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে। বুধা মিলিটারির দিকে তাকিয়ে ছিল। কোন ভাষা নেই সে দৃষ্টিতে। সাধারণত প্রাণহীন দৃষ্টি হিংত্র হয়, এই হিংস্রতা বুধা দেখেছে। যে মানুষের দৃষ্টিতে ভাষা নেই, সে মানুষকে বুধার মানুষ মনে করে না।

গ. উদ্দীপকের হাসেম ব্যাপারির সাথে কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে বর্ণিত আহাদ মুন্সি চরিত্রের সাদৃশ্যের দিকটি ব্যাখ্যা করাে।

কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে আহাদ মুন্সি একটি দালাল ও নিষ্ঠুর চরিত্র এবং উদ্দীপকের হাসেম ব্যাপারীও এ দালালী ও নিষ্ঠুরতায় বিশ্বাসী। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ দেশের মানুষের ওপর তীব্র নির্মমতা চালায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। তখন হানাদারদের সঙ্গে যোগ দেয় এদেশেরই কিছু স্বার্থপর লোক। তারা সম্পদ লুগ্ঠন করে, নারীদের জোড় করে হানাদারদের হাতে তুলে দেয়; তখন হেন অপরাধ নেই, যা তারা করেনি। উদ্দীপকে মফিজ খাঁর চরিতেও এমন নিষ্ঠুরতার পরিচয় পাওয়া যায়। জমিদার হওয়ার কারণে সে সাধারণ প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালায়। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করে হাসেম ব্যাপারী। জমিদারের কাছের লোক হওয়ায় সে মানুষের ওপর পুকুরের মাছ ধরে নিয়ে আসে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে গ্রামছাড়া করে। “কাকতাড়ুয়া উপন্যাসে আহাদ মুন্সিও বর্বর হানাদারদের সহযোগী। হানাদারদের দোসর হয়ে সে গ্রামের লোকজনের ওপর নির্যাতন চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নানা তথ্য সরবারহ করে সে হানাদারদের সাহায্য করে। গ্রামের মানুষদের জোড় করে সেনাদের বাঙ্কার নির্মাণ করতে নিয়ে যায়। তার আদেশেই বুধাকে জোড় করে কাকতাড়ুয়া বানিয়ে রাখা হয় ও মাঠের মাঝখানে। আহাদ মুন্সির এ ধরনের অন্যায় অত্যাচারের সাথে উদ্দীপকের হাসেম ব্যাপারীর চরিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।

ঘ. উদ্দীপকে বর্ণিত দিকটিই ‘কাকতাড়ুয়া' উপন্যাসের একমাত্র দিক নয়- যুক্তিসহ বুঝিয়ে লেখ।

উদ্দীপকের দিকটিই “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসের একমাত্র দিক নয়- মন্তব্যটি যথার্থ। ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী শাষকগোষ্ঠি নানাভাবে পূর্ব ংলার মানুষের শোষণ করে। বাঙালি এর প্রতিবাদ জানালে শুরু হয় নানা অত্যচার ও বর্বরতা। তারা গণহত্যায় মেতে ওঠে। সমস্ত দেশ ল-ভ- করে দিতে শুরু করে। বাঙালি এক সময় জেগে ওঠে। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির সাহস ও শক্তির কাছে অবশেষে হার মেনে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। ব্যাপারী। সে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়। মানুষ তার ভয়ে কাপত। কারণ সে কারও পুকুরের মাছ, কারও গোয়ালের গরু আবার কারও ঘরের টিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যেত।

“কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে এমন চরিত্রধারী হল আহাদ মুন্সি। সে হানাদারদের দোসর। এ সুযোগে সে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার ও নিগীড়ন চালায়। গ্রামের মানুষকে ভয় দেখিয়ে সে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য করায়। বাঙ্কার খোড়ার জন্য সে মানুষদের ধরে নিয়ে যায়। “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে আহাদ মুন্সির চরিত্রই মূল বিষয় নয়; মুল বিষয় হল কিশোর বুধার চেতনায় দেশপ্রেম ও সাহসী রূপ। কারণ সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা কৌশলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও বুধার একাকী জীবন, কলেরার প্রকোপ, দারিদ্রের টানাপোড়ন, হানাদারদের পৈশাচিকতা, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও সাফল্য ইত্যাদি দিকগুলো “কাকতাড়ুয়া” উপন্যাসে প্রকাশ পেয়েছে। এসব দিক উদ্দীপকে অনুপস্থিত। তাই বলা যায়, উদ্দীপকের দিকটিই “কাকতাড়ুয়া উপন্যাসের একমাত্র দিক নয়।

Leave a Comment