জীবন-সঙ্গীত – হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

জীবন-সঙ্গীত (Jibon-Sangeet) – হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (Hemchandra Bandyopadhyay) কবিতাটি ৯ম-১০ম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য বইয়ের একটি অধ্যায়। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত “জীবন-সঙ্গীত” অধ্যায় এর লেখক পরিচিতি, গল্প, কবিতা, শব্দার্থ ও টীকা, পাঠ পরিচিতি, অনুশীলনী, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেওয়া হলো।

জীবন-সঙ্গীত

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

বলো না কাতর স্বরে          বৃথা জন্ম এ সংসারে

এ জীবন নিশার স্বপন,

তুমি কার কে তোমার          বলে জীব করো না ক্রন্দন;

দারা পুত্র পরিবার,

মানব-জনম সার,          এমন পাবে না আর

বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে মন;

কর যত্ন হবে জয়,          জীবাত্মা অনিত্য নয়,

ওহে জীব কর আকিঞ্চন ।

করো না সুখের আশ,          পরো না দুখের ফাঁস,

জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়,

সংসারে সংসারী সাজ,          করো নিত্য নিজ কাজ,

ভবের উন্নতি যাতে হয়।

দিন যায় ক্ষণ যায়,          সময় কাহারো নয়,

বেগে ধায় নাহি রহে স্থির,

সহায় সম্পদ বল,          সকলি ঘুচায় কাল,

আয়ু যেন শৈবালের নীর।

সংসারে-সমরাঙ্গনে          কর যুদ্ধ বীর্যবান,

যুদ্ধ কর দৃঢ়পণে,

ভয়ে ভীত হইও না মানব ;          যায় যাবে যাক প্ৰাণ

মহিমাই জগতে দুর্লভ।

মনোহর মূর্তি হেরে,          ওহে জীব অন্ধকারে,

ভবিষ্যতে করো না নির্ভর

অতীত সুখের দিন,          পুনঃ আর ডেকে এনে,

চিন্তা করে হইও না কাতর ।

মহাজ্ঞানী মহাজন,          যে পথে করে গমন,

হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,

সেই পথ লক্ষ্য করে          স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে

আমরাও হব বরণীয়

সমর-সাগর-তীরে,          পদাঙ্ক অঙ্কিত করে

আমরাও হব হে অমর;

সেই চিহ্ন লক্ষ করে,          অন্য কোনো জন পরে,

যশোদ্ধারে আসিবে সত্বর।

করো না মানবগণ,          বৃথা ক্ষয় এ জীবন,

সংসার-সমরাঙ্গন মাঝে;

সঙ্কল্প করেছ যাহা,          সাধন করহ তাহা,

রত হয়ে নিজ নিজ কাজে।

কবি-পরিচিতি

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের ১৭ই এপ্রিল হুগলি জেলার গুলিটা রাজবল্লভহাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার খিদিরপুর বাংলা স্কুলে পড়াশোনাকালে আর্থিক সংকটে পড়েন। ফলে তাঁর পড়াশোনা তখন বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীর আশ্রয়ে তিনি ইংরেজি শেখেন। পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজে সিনিয়র স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি ১৮৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি সরকারি চাকরি, স্কুল-শিক্ষকতা এবং পরিশেষে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পরে কাব্য রচনায় তিনিই ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান। স্বদেশপ্রেমের অনুপ্রেরণায় তিনি ‘বৃত্রসংহার’ নামক মহাকাব্য রচনা করেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : চিন্তাতরঙ্গিনী, বীরবাহু, আশাকানন, ছায়াময়ী ইত্যাদি। ২৪শে মে ১৯০৩ সালে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন।

শব্দার্থ ও টীকা

কাতর স্বরে – দুর্বল কণ্ঠে, করুণভাবে।

দারা – স্ত্রী।

বাহ্যদৃশ্যে – বাইরের জগতের চাকচিক্যময় রূপে বা জিনিসে।

জীবাত্মা – মানুষের আত্মা, আত্মা যদিও অমর, কিন্তু মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কাজেই দেহ ছেড়ে আত্মা একদিন চলে যাবে, চিরকাল দেহকে আঁকড়ে থাকতে পারবে না।

অনিত্য – অস্থায়ী, যা চিরকালের নয়।

আকিঞ্চন – চেষ্টা, আকাঙ্ক্ষা;

আশ – আশা

ভবের – জগতের, সংসারের।

সমরাঙ্গনে – যুদ্ধক্ষেত্রে (কবি মানুষের জীবনকে যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন)।

বীর্যবান – শক্তিমান।

মহিমা – গৌরব।

প্রাতঃস্মরণীয় – সকাল বেলায় স্মরণ করার যোগ্য, অর্থাৎ সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র।

ধ্বজা – পতাকা, নিশান।

বরণীয় – সম্মানের যোগ্য।

সংসারে সমরাঙ্গনে – যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসী সৈনিকের মতো সংসারেও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে হবে।

স্বপন – রাতের স্বপ্নের মতোই মিথ্যা বা অসার।

আয়ু যেন শৈবালের নীর – শেওলার ওপর পানির ফোঁটার মতো ক্ষণস্থায়ী।

পাঠ-পরিচিতি

আমাদের জীবন কেবল নিছক স্বপ্ন নয়। কাজেই এ পৃথিবীকে শুধু স্বপ্ন ও মায়ার জগৎ বলা যায় না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং পরিজনবর্গ কেউ কারও নয়, একথাও ঠিক নয়। মানব – জন্ম অত্যন্ত মূল্যবান। মিথ্যা সুখের কল্পনা করে দুঃখ বাড়িয়ে লাভ নেই তা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যও নয়। সংসারে বাস করতে হলে সংসারের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। কেননা বৈরাগ্যে মুক্তি নেই। আমাদের জীবন যেন শৈবালের শিশিরবিন্দুর মতো ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং মানুষকে এ পৃথিবীতে সাহসী যোদ্ধার মতো সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হবে। মহাজ্ঞানী ও মহান ব্যক্তিদের পথ অনুসরণ করে আমাদেরও বরণীয় হতে হবে। কেননা জীবন তো একবারই। ‘জীবন সঙ্গীত’ কবিতাটি মার্কিন কবি ‘Henry Wadsworth Longfellow- (১৮০৭-১৮৮২) এর ‘A Psalm of life’ শীর্ষক ইংরেজি কবিতার ভাবানুবাদ ।

কৰ্ম-অনুশীলন

১। তুমি আদর্শ মনে কর এমন একজন মানুষের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আয়ুকে কোনটির সাথে তুলনা করেছেন?

ক. নদীর জল

খ. পুকুরের জল

গ. শৈবালের নীর

ঘ. ফটিক জল

২। কবি ‘সংসার সমরাঙ্গন’ বলতে কী বুঝিয়েছেন ?

ক. যুদ্ধক্ষেত্রকে

খ.জীবনযুদ্ধকে

গ.প্রতিরোধ যুদ্ধকে

ঘ.অস্তিত্বকে

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও :

শুকুর মিয়া একজন খুদে ব্যবসায়ী। সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম প্রথম লাভ পান। এক সময় তার ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়। এতে তিনি কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। তখন বন্ধু হাতেম তাকে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে চলার পরামর্শ দেন। শুকুর মিয়া তার পরামর্শকে সাদরে গ্রহণ করেন ।

৩। উদ্দীপকের শুকুর মিয়ার লক্ষ্য কী?

ক.যশোদ্ধার

খ.অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা

গ.সংসার সমরাঙ্গনে টিকে থাকা

ঘ.বরণীয় হওয়া

৪। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে শুকুরের যে গুণের আবশ্যক তা হলো –

ক. সাহস

খ.সংগ্ৰাম

গ.আত্মবিশ্বাস

ঘ.সঙ্কল্প

সৃজনশীল প্রশ্ন

রবার্ট ব্রুস পর পর ছয়বার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এক সময় হতাশ হয়ে বনে চলে যান। সেখানে দেখেন একটা মাকড়সা জাল বুনতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। অবশেষে সেটি সপ্তমবারে সফল হয়। এ ঘটনা রবার্ট ব্রুসের মনে উৎসাহ জাগায়। তিনি বুঝতে পারেন জীবনে সাফল্য ও ব্যর্থতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই তিনি আবার পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন।

ক. কবি কোন দৃশ্য ভুলতে নিষেধ করেছেন?

খ. কীভাবে ‘ভবের’ উন্নতি করা যায়?

গ. পরাজয়ের গ্লানি রবার্ট ব্রুসের মনের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করে সেটি ‘জীবন সঙ্গীত’ কবিতার সাথে কীভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ তা ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. ‘হতাশা নয় বরং সহিষ্ণুতা ও ধৈর্যই মানুষের জীবনে চরম সাফল্য বয়ে আনে।’—উদ্দীপক ও ‘জীবন-সঙ্গীত’ কবিতা অবলম্বনে উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।

[tag-list tag=৯ম-১০ম-শ্রেণীর-বাংলা-সহপাঠ-বই]