পাঠ ২- বিভিন্ন বয়সের শিশুর বৈশিষ্ট্য
১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ ঘােষিত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের নিচে সকলকে শিশু বলে গণ্য করা হয়।
এখন প্রশ্ন হতে পারে- একটি সদ্যোজাত শিশু কিংবা একটি ৫ বছরের শিশুর বৈশিষ্ট্য কি এক? কখনই না। তাই শিশুর বিভিন্ন বয়সের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে শিশুকালকে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে।
- জন্ম মুহূর্ত থেকে ২ সপ্তাহ- নবজাতক কাল
- ২ সপ্তাহ থেকে ২ বছর পর্যন্ত অতি শৈশব
- ২ বছর থেকে ৬ বছর পর্যন্ত প্রারম্ভিক শৈশব
- ৬ বছর থেকে ১০/১১ বছর পর্যন্ত- মধ্য শৈশব
প্রতিটি শিশুই পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিভিন্ন বয়সের শিশুর বৈশিষ্ট্য আমাদের জানা দরকার। কারণ
- শিশুর সাথে সঠিক আচরণ করতে পারব।
- বিভিন্ন বয়সের শিশুর চাহিদা পূরণ করতে পারব।
- শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে নতুন মা-বাবাকে সচেতন করতে পারব।
- যে কোনাে ধরনের অস্বাভাবিকতায় সময়মতাে চিকিৎসা করাতে পারব।
- বড় ভাই-বােন হিসেবে তাকে যত্ন ও সঙ্গ দিতে পারব। নবজাতক কাল- যে সব শিশু জন্মের সময় লালচে বা গােলাপি বর্ণের হয়, জন্ম মুহূর্তে কাঁদে, স্বাভাবিকভাবে দুধ খেতে পারে, তারাই সুস্থ নবজাতক। নবজাতক দিনে প্রায় ১৮-২০ ঘণ্টা ঘুমায়। দু-তিন ঘণ্টা পর পর জেগে ওঠে, আহার করে, মল-মূত্র ত্যাগের পর আবার ঘুমায়।
আরও কিছু লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য দিয়ে আমরা নবজাতকের সুস্থতা বুঝতে পারব।
উপরােক্ত যে কোনাে একটি অভিব্যক্তি অনুপস্থিত থাকলে নবজাতকটি যে স্বাভাবিক নয় তা বােঝা যায়। তখন দেরি না করে শিশুটিকে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।
পাঠ ৩- অতি শৈশব কাল
নবজাতক সময়ের পর বা ২ সপ্তাহ থেকে ২ বছর পর্যন্ত কালকে অতি শৈশব কাল বলা হয়। আবার দেড় বছর থেকে যখন শিশু হাঁটতে থাকে তখন তাদেরকে ‘টডলারও বলা হয়। এ সময়ে শিশুর বিকাশ এত দ্রুত হয় যে, কিছুদিন পরপরই পরিচিত জনের কাছেও শিশুকে অনেক বড় এবং অচেনা লাগে। জন্মের সময় যে শিশুটি বড় অসহায় ছিল সে এখন হাঁটতে পারে, লাফালাফি করতে পারে, কথা বলতে পারে, আরও কত কী!
খাদ্য, পুষ্টি, যত্ন, বাবা-মায়ের আকার আকৃতি ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন শিশুর বৃদ্ধি বিভিন্ন রকম হয়। কিন্তু তবুও এ বয়সে ওজন ও উচ্চতা বাড়ার একটি স্বাভাবিক নিয়ম আছে। শিশুর ওজন জন্মকালীন ওজনের দ্বিগুণ হয় ছয় মাসে। এক বছরে হয় তিনগুণ। দু’বছরে হয় চারগুণ। তিন বছরে হয় পাঁচগুণ। জন্মের সময় শিশুর যা দৈর্ঘ্য থাকে, চার-পাঁচ বছরে তা দ্বিগুণ হয়। পরবর্তী বছরগুলােতে ওজন বাড়ার হার ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশু আমরা তাকেই বলব, যার বয়স অনুযায়ী ওজন ও উচ্চতা স্বাভাবিক, চোখ স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল, চামড়া, চুল চকচকে ও মসৃণ, চেহারায় আছে আনন্দ ও পরিতৃপ্তির ছাপ।
ছােট্ট শিশুটির যত্নে আমাদের করণীয়
- ক্ষুধা লাগলেই তাকে খাবার দেওয়া। • মল-মূত্র ত্যাগ করলে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করা, ভেজা অবস্থায় না রাখা। • কান্নার সময় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার অসুবিধা দূর করা। • অতিরিক্ত গরম বা শীতে তার যেন কষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল করা। • ভয় পেলে কোলে তুলে নেওয়া। • আরামদায়ক ঘুমের ব্যবস্থা করা।
উপযুক্ত খাদ্য শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, খাদ্যের সাথে সাথে মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য দরকার স্নেহ, ভালােবাসা ও উদ্দীপনার।
শিশুর যত্নে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু যে সব পরিবারে অন্যান্য সদস্যরা শিশু পালন, খেলা, ভাব বিনিময়ে অংশ নেয়- সে সব শিশু অন্য শিশুদের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যবান ও বুদ্ধিমান হয়। তারা অধিক নিরাপত্তার মধ্যে বেড়ে ওঠে।
পাঠ ৪- প্রারম্ভিক শৈশব (Early Childhood)
২ বছর থেকে ৬ বছর পর্যন্ত সময় প্রারক্তিক শৈশব বা শৈশবের প্রথম পর্যায়। এ বয়সের অন্য আর একটি নাম হলাে প্রাক বিদ্যালয় শিশু বা স্কুল পুর্বের শিশু। এটা এমন একটা বয়স যখন শিশু আনুষ্ঠানিক ভাবে স্কুলে পড়াশােনা শুরু করে না কিন্তু স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আবার কোনাে কোনাে শিশু এ বয়সে স্কুলে যায়, তারা স্কুলে খেলা-ধুলার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক পড়াশােনা শুরুর প্রস্তুতি নেয়। এ সময়কে খেলার বয়সও বলা হয়।
এ সময়টা শিশুর আনন্দের সময়। পৃথিবী তার কাছে একটা বিরাট বিস্ময়। নিজেকে, অপরকে, আশে-পাশের সবকিছুকে নিয়ে আছে হাজারাে প্রশ্ন। প্রত্যেক বিষয়ে সে অনর্গল প্রশ্ন করে। সে সবকিছু শিখতে চায়। এ বয়সটা আগ্রহ ও কৌতুহলের। ধমক দিয়ে বা বিরক্ত হয়ে তাকে থামিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তার সকল প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে দিয়ে তাকে উৎসাহী করে তুলতে হবে। এটা কী, ওটা কী, এটা কেন হয় এসব প্রশ্নের মাধ্যমে তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে।
কথােপকথন
আসিফ- আমি একশাে শুনতে পারি।
রাইয়ান- আমি একশাে হাজার গুনতে পারি।
আসিফ- আমি দুইশাে হাজার গুনতে পারি।
রাইয়ান- আমি পৃথিবীর সবার চেয়ে বেশি গুনতে পারি।
উপরের কথােপকথনটি দুইটি প্রাক বিদ্যালয় শিশুর মধ্যে কথােপকথন। এ বয়সে তারা প্রচুর কথা বলতে পারে। তারা থাকে আত্মকেন্দ্রিক। এ জন্য নিজ সম্পর্কে তারা বেশি কথা বলে। কোন কোন বিষয় তার কাছে আনন্দের, তার পরিবারে কে কে আছে, তার কী কী জিনিস আছে- সে সম্পর্কে বলতে আগ্রহী হয়।
তারা সমবয়সীদের সাথে প্রতিযােগিতা করতে শুরু করে। এভাবেই তাদের সামাজিক বিকাশ ঘটে। এ বয়সে শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হয়। যে ব্রনের কাজ তাদের সামনে করা হয়, সেভাবেই তারা অভিনয় করে, খেলে। যেমন- বাবার মতাে খবরের কাগজ পড়া, মায়ের মতাে সকলকে পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। এ বয়সে শিশুদের জীবনে সঠিক পরিবর্তন আনার জন্য দামি খেলনা, ব্যয়বহুল উপকরণের প্রয়ােজন হয় না।
পরিবারের সদস্যদের তাদের জন্য যা করণীয় তা হলাে
- তাদের সঙ্গে ঘরে ও বাইরে সুন্দরভাবে কথা বলা। • মনােযােগ দিয়ে তাদের কথা শােনা।
- বিরক্ত না হয়ে তাদের প্রশ্নের সহজ উত্তর দেওয়া।
- তাদেরকে গান, ছড়া, গল্প শােনান। • তাদেরকে সময় দেওয়া, তাদের সাথে খেলাধুলা করা। • নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে তাদেরকে পরিচিত করা বা ধারণা দেওয়া। • নতুন কিছু দেখতে, শুনতে, করতে ও স্বাদ
শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য এ কাজগুলাে ভালােভাবে যত বেশি করা হবে, ততই তার জন্য মঙ্গলজনক।
পাঠ ৫- মধ্য শৈশব (Middle Childhood)
৬ বছর থেকে ১০/১১ বছর পর্যন্ত বয়সকে মধ্য শৈশব বলে ধরা হয়। এ সময়ে শিশুর শারীরিক বিকাশ ধীর গতিতে চলে। কিন্তু সামাজিক জীবনে আসে বিস্ময়কর পরিবর্তন। অধিকাংশ শিশু স্কুলে যাওয়া শুরু করে। হক বাঁধা জীবনে এটি একটি প্রধান পরিবর্তন। এ বয়সটি দলীয়ভাবে খেলার বয়স। ছেলেরা ছেলেদের দলে এবং মেয়েরা মেয়েদের দলে খেলাধুলা করে। স্কুলে যাওয়া ও খেলাধুলার কারণে সমবয়সীদের সাথে তার ব্যাপক যােগাযােগ হয়।
এ বয়সে তাদের মধ্যে প্রয়ােজনীয় দক্ষতা তৈরি হয়। নিজের কাজ নিজে করতে পারে। খাওয়া, পােশাক পরা ইত্যাদি কাজ অল্প সময়ে অল্প পরিশ্রমে করতে পারে। নিজের কাজের পাশাপাশি ঘরে বাইরে নানা ধরনের কাজ করতে পারে। যেমন- বাগান করা, ঘর গােছানাে ও পরিষ্কার করা ইত্যাদি।
এ বয়সে শিশুরা স্কুলে গল্প-কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, দুই চাকার সাইকেল চালানাে, সাঁতার কাটা ইত্যাদি নানা রকম কাজ করে। এভাবে বিভিন্ন কাজে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা উদ্যমী ও পরিশ্রমী হয়। নতুন নতুন কাজে সাফল্য তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। সমবয়সীদের সাথে বিভিন্ন রকম প্রতিযােগিতা করে। এ সময়ের সফলতা তার ভবিষ্যৎ সফলতার দরজা খুলে দেয়। অপর দিকে ব্যর্থতা তার মধ্যে সৃষ্টি করে হতাশা। এই হতাশা থেকে নানা রকম আচরণগত সমস্যা তৈরি হতে পারে। যেমন- অতিরিক্ত রাগ, জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলা বা ভাংচুর করা, কাউকে আঘাত করা, বিষণ্ণতা, সামান্য কারণে কেঁদে ফেলা, স্কুলে যেতে না চাওয়া ইত্যাদি।
ভালাে আচরণের জন্য বড়দের প্রশংসা শিশুর নিরাপত্তাবােধ জাগিয়ে তােলে। শিশুকে যখন প্রশংসা করা হয় তখন সে বুঝতে পারে যে আচরণটি করছে তা বড়দের কাছে গ্রহণযােগ্য। এটি তার মধ্যে ভালাে। আচরণের ইচ্ছা জাগিয়ে তােলে। তারা আরও ভালাে কাজ করতে আগ্রহী হয়। শিশুরা চায় প্রশংসা ও ভালােবাসা। অপরদিকে যে কোনাে কারণে বড়দের দেওয়া শাস্তি তাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়। তারা নতুন কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
কোনাে কারণে পরীক্ষার ফল খারাপ হলে নিরুৎসাহিত হওয়া বা সাহস হারানাে ঠিক না। এতে ভবিষ্যৎ। সফলতায় বাধার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক সময় মা-বাবাও হতাশ হয়ে পড়েন এবং সন্তানদেরকে তিরস্কার বা রাগারাগি করে থাকেন। বড়দের নেতিবাচক উক্তি শিশুদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে। এতে ভবিষ্যৎ সফলতায় বাধার সৃষ্টি হয়। এভাবে বাড়িতে ছােটদের ব্যর্থতায় তােমাদেরকেও। সচেতন হতে হবে। তাদেরকে মনােবল ফিরিয়ে আনার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
Very beautiful answer..
Awesome…