0

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সমাজিক পরিস্থিতিতে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমেই জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব এর যৌক্তিকতা নিরূপণ। এইচএসসি সমাজকর্ম ২য় পত্র ৮ম সপ্তাহের এসাইনমেন্ট ২০২২ সমাধান।

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সমাজিক পরিস্থিতিতে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমেই জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব

বিষয়: সমাজকর্ম ২য় পত্র, বিষয় কোড: ১৭২, অ্যাসাইনমেন্ট নম্বর: ০২, স্তর: এইচএসসি, প্রথম অধ্যায়: বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক চাহিদা।

অ্যাসাইনমেন্ট: বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ মােকাবেলার মাধ্যমেই জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব এর যৌক্তিকতা নিরূপণ।

বিষয়বস্তু

  • ১. মৌলিক মানবিক চাহিদা ব্যাখ্যা করতে পারবে
  • ২. বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
  • ৩. বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদার অপূরণজনিত সমস্যা বিশ্লেষণ করতে পারবে
  • ৪. বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক চাহিদাপূরণে গৃহীত পদক্ষেপ বর্ণনা করতে পারবে

নির্দেশনা

  • ক. মৌলিক মানবিক চাহিদার ধারণা ব্যাখ্যা করা
  • খ. সম্প্রতিক তথ্যের আলােকে বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতি
  • গ. বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদার অপূরণজনিত সমস্যা বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদা
  • ঘ. পূরণের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের উপায়
  • ঙ. জীবন মান উন্নয়নের পক্ষে যৌক্তিকতা

এইচএসসি সমাজকর্ম ২য় পত্র ৮ম সপ্তাহের এসাইনমেন্ট ২০২২ উত্তর

মৌলিক মানবিক চাহিদার ধারণাঃ 

 নিচে মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদা ও এর উদাহরণ দেওয়া হলঃ-

মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছুরই চাহিদা অনুভব করে। কিন্তু সকল প্রকার চাহিদা মৌলিক মানবিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রধানত দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং সামাজিক জীবনের উৎকর্ষ সাধনের জন্য যে সকল চাহিদা পূরণ করা অপরিহার্য, সেগুলোই মৌলিক মানবিক চাহিদার পর্যায়ভুক্ত। মৌলিক মানবিক চাহিদা মূলত দু’ধরনের চাহিদার সমন্বয়। যেমন, 

(ক) মৌলিক চাহিদা (Basic Needs)

(খ) মানবিক চাহিদা (Human Needs)

মানবিক মৌলিক চাহিদার কিছু উদাহরণঃ-

(ক) মৌলিক চাহিদা: মানুষসহ যেকোনো জীবন্ত প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা, দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য যেসব চাহিদা পূরণ করা অপরিহার্য তাকে মৌলিক চাহিদা বলে। একে জৈবিক বা দৈহিক চাহিদাও বলা হয়। এ চাহিদার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মানুষসহ সকল জীবন্ত প্রাণীর বেঁচে থাকা এবং দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য এটি পূরণ করা অত্যাবশ্যক। মৌলিক চাহিদার আওতায় আসে খাদ্য, ঘুম ইত্যাদি।

(খ) মানবিক চাহিদা: সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য যে সকল চাহিদা পূরণ একান্ত অপরিহার্য, সেগুলোকে মানবিক চাহিদা বলে। মানবিক চাহিদা অনেক সময় সামাজিক চাহিদা হিসবে আখ্যায়িত হয়। এটা শুধু মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সমাজবদ্ধ সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানবিক চাহিদা পূরণ করা সামাজিক জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ চাহিদাগুলো মানুষকে সমাজের অন্য প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদা দিয়েছে। মানবিক চাহিদা হলো বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি।

বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতিঃ 

বাংলাদেশের ৬ টি মৌলিক মানবিক চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করা হলোঃ- 

১। খাদ্য: খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবনধারণ, দৈহিক ও মানসিক বিকাশে অপরিহার্য উপাদান হলো খাদ্য। অধিক জনসংখ্যা, অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা, আবাদি জমি হ্রাস, ভূমির অনুর্বরতা ও খণ্ড-বিখণ্ড তা, ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্যদ্রব্যের অসম বণ্টন ইত্যাদি বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যার প্রধান কারণ। বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির প্রভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ন্যূনতম খাদ্যমান অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে বাংলাদেশে খাদ্যের ন্যায় মৌলিক চাহিদা পূরণ প্রতিক‚ল অবস্থা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ জন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৬ শতাংশ। মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র ০.১৫ একর অথচ একজন মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য ন্যূনতম ১.৬৮ একর আবাদযোগ্য জমির প্রয়োজন। বর্তমান জনসংখ্যার সাথে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ নতুন মুখ, যারা আবাদি জমির পরিমাণ কমাচ্ছে, বিপরীতে খাদ্য চাহিদা বাড়াচ্ছে। [newresultbd.com] ফলে খাদ্য গ্রহণের পরিমান পর্যায়ক্রমে কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশে ৩১.৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বাজারে খাদ্যসামগ্রী থাকা সত্বেও এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সুষম ও প্রয়োজনীয় খাদ্য ক্রয়ের সামর্থ রাখে না। ফলে অনেকেই খাদ্যাভাবে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটায়, নয়তো অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে ক্ষুধার তাড়না মেটানোর চেষ্টা করে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশগত কারণে প্রায় প্রতিবছরই মৌসুমি অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন প্রভৃতি দুর্যোগ ফসলের ও অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। যেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়াই অনুন্নত সেখানে এ সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয় খাদ্য উৎপাদন সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলে। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি রক্ষার জন্য একজন মানুষের প্রতিদিন ২৫ আউন্স খাদ্যের প্রয়োজন অথচ বাংলাদেশে একজন লোকের গড় খাদ্য গ্রহণের পরিমান মাত্র ১৫ আউন্স। বাংলাদেশ পরিসখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন হয়েছিল ৩৮১.৭৪ লাখ মেট্রিক টন, আমদানি করা হয়েছিল ৩১.২৪ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে (ফেব্রæয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত) সার্বিকভাবে দেশে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮.৪৩ লাখ মেট্রিক টন।

নিচের সারণিতে ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান দেখানো হলোঃ-

২। বস্ত্র: মৌলিক মানবিক চাহিদার মধ্যে খাদ্যের পরই বস্ত্রের স্থান। বস্ত্র সভ্যতার সর্বপ্রধান নির্দেশক ও নিদর্শন। বাংলাদেশে বস্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক মানবিক চাহিদা আর্থিক কারণে সব শ্রেণির জনগণের পক্ষে যথাযথ ভাবে পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। ত্রæটিপূর্ণ বস্ত্রনীতি, বস্ত্রশিল্পের জাতীয়করণের ফলে সৃষ্ট অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, প্রতিকূল পরিবেশ, দুর্ঘটনা, উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি বাংলাদেশের বস্ত্র সমস্যাকে তীব্র করে তুলেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে মাথাপিছু বস্ত্রের চাহিদা হলো বছরে ১০ মিটার। এ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বার্ষিক বস্ত্রের চাহিদার পরিমাণ প্রায় ১৫১ কোটি মিটার। তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য প্রয়োজন প্রায় ২৫০ কোটি মিটার। অর্থাৎ মোট চাহিদা হচ্ছে ৪০১ কোটি মিটার। অথচ বস্ত্রখাতে মোট উৎপাদন প্রায় ৩০০ কোটি মিটার। [newresultbd.com] ফলে বর্তমানে দেশে বস্ত্রঘাটতির পরিমাণ হলো প্রায় ১০১ কোটি মিটার। অন্য এক হিসাবে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু পুরাতন কাপড়ের ব্যবহার ০.১ মিটার এব নতুন কাপড় ১২.৩ মিটার। উপর্যুক্ত তথ্য থেকে বাংলাদেশে বস্ত্রের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় নিতান্তই কম হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদি ব্যষ্টিক পর্যায়ে বস্ত্রের বাস্তব অবস্থা ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে আরও হতাশাজনক চিত্র পাওয়া যাবে। বস্ত্রের চাহিদা পূরণে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ পুরাতন কাপড় বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। বস্ত্রের অভাবে একদিকে অসংখ্য দরিদ্র ও দুস্থ মানুষ শীত ও গ্রীষ্মকালে প্রতিকূল পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে বস্ত্রের চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশি পুরাতন কাপড় আমদানি জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

৩. বাসস্থান: সমাজ ও সভ্যতাকে স্থিতিশীল রূপদানের ক্ষেত্রে বাসস্থানের অবদান সবচেয়ে বেশি। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে শহর ও গ্রাম উভয় এলাকায়ই বাসস্থান সমস্যা প্রকট। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে এদেশের প্রায় ১০ লাখ লোক গৃহহীন। এরা অন্যের বাড়িতে, অফিস, দোকানপাটের বারান্দায়, পার্কে রাত কাটায়। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব মতে, গ্রামীণ জনগণের ৭% অন্যের বাড়িতে, ২২.৬% জরাজীর্ণ বাসগৃহে এবং শহরের ৮% লোক বস্তিতে মানবতের জীবনযাপন করছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে বসতভিটাহীন পরিবারের সংখ্যা ১৪ লাখ ৯১ হাজার ৮৫৫টি। জনসংখ্যা ও গৃহগণনা রিপোর্ট ২০১১ অনুযায়ী এদেশে গৃহনির্মাণ কাঠামোর ধরন তুলে ধরা হলোঃ-

উপর্যুক্ত বাস্তব তথ্যসমূহ থেকে বাংলাদেশে বাসস্থানের মতো মৌলিক মানবিক চাহিদার করুণ চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে প্রতি বছর ১.৩৬%। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য প্রায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার নতুন বাসগৃহের প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না বলে আবাসন সমস্যা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। যদিও আবাসনের চাহিদা মোকাবিলার জন্য নতুন বাসগৃহতৈরি হয় এর বৃদ্ধির হার খুবই কম, যা নিচের সারণি থেকে সহজেই বোঝা যায়।

৪. শিক্ষা: অন্যান্য মৌলিক মানবিক চাহিদার মতো শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। শিক্ষিতের হার বাড়ছে, তবে তা খুবই ধীরগতিতে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৫ অনুযায়ী বর্তমান সাক্ষরতার হার মাত্রশতকরা ৬২.৩ ভাগ। যার মধ্যে পুরুষ শতকরা ৬৫.০ ভাগ এবং মহিলা ৫৯.৭ ভাগ। বর্তমানে স্কুলে শিশুদের নিবন্ধের হারবৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু তাদের শতকরা ৭৫ জন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করে স্কুল ছেড়ে দেয়। স্কুল ত্যাগী শিশুর হার শতকরা ৩৪ ভাগ। বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বর্তমানে শিক্ষাখাতকে ব্যাপক অগ্রাধিকার প্রদান করে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্রছাত্রী ভর্তির সংখ্যা ও হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিচে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রাথমিক স্তরে ছাত্রছাত্রী ভর্তির হার সারণিতে দেখানো হলোঃ-

৫. স্বাস্থ্য: বাংলাদেশে স্বাস্থ্য চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ হয় না। স্বাস্থ্যহীনতা এদেশের একটি অতি পরিচিত চিত্র। প্রতিবছর এ দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারায়। অনেকে স্বাস্থ্যহীনতা ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে কোনো রকমে জীবনের ঘানি টেনে চলে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ লোক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ন্যূনতম সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৫-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে ২,১২৯ জনের জন্য মাত্র ১ জন ডাক্তার এবং ১,৬৫২ জন রোগীর জন্য সরকারি হাসপাতালে মাত্র ১টি শয্যার ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ও সেবক-সেবিকার সংখ্যাও হতাশাব্যঞ্জক। দেশের প্রায় ১৫ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য চাহিদা কোনো মতেই পূরণ হচ্ছে না। তারই একটি

সংখ্যাচিত্র নিচে সারণির মাধ্যমে তুলে ধরা হলো:

আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ বলতে গেলে শহরের এবং উপজেলা সদরে সীমাবদ্ধ। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আধুনিক চিকিৎসা একটা দুরাশামাত্র। দেশের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৪ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ৯ জন চিকিৎসক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এ সকল হাসপাতালে সকল প্রকার রোগের প্রধানত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিশেষায়িত চিকিৎসার সুযোগ অতি সীমিত। বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য জেলা বা বিভাগীয় শহরের আসতে হয়। জনগণকে চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে জুন-২০১৩ পর্যন্ত দেশে ৩,৮৮১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র, ৪২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৫৯টি জেলা হাসপাতাল ৭৫টি মেডিকেল কলেজ ও ৮২টি সেবিকা প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

Maternal Mortality and Health Care Survey, 2011, ২০১১-এর রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাতৃ মৃত্যুহার ২০০১ সালে ৩.২ শতাংশ থেকে ২০১৪ সালে ১.৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রজনন হার ও মৃত্যুহার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ নবজাতক শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৭০% শিশু রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’র অভাবে বছরে প্রায় ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও গলগন্ড রোগ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে সুপেয় পানি গ্রহণকারী হার ৯৮.৩% এবং স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারকারীর হার ৬৩.৮%। সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনগণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্যঘাটতি, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য, খাদ্য গ্রহণের নিম্নমান ও স্বল্পতা, চিকিৎসা সুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবার স্বল্পতা, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা ইত্যাদি কারণে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা বিরাজ করছে।

৬. চিত্তবিনোদন: বাংলাদেশে অন্যান্য মৌলিক চাহিদার মতো চিত্তবিনোদনের চাহিদাও ঠিকমতো পূরণ হয় না। কারণ নির্মল আনন্দ লাভের ব্যবস্থা বর্তমানে সীমিত হয়ে এসেছে। একসময় গ্রামগুলোতে জারিগান, সারিগান, বাউল গান, পুঁথিপাঠ, যাত্রানুষ্ঠান, পালাগান, সড়কপথে ভাওয়াইয়া, নদ-নদীতে ভাটিয়ালী এবং মাঠ-ঘাট পল্লিগীতিতে মুখরিত ছিল। কাবাডি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, কানামাছি ইত্যাদি খেলাধুলার মাধ্যমে আমোদ-প্রমোদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল। এখন দারিদ্র্য ও শহরায়ণের প্রভাবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা প্রায় লোপ পেয়ে গেছে। খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য মাঠের খালি জায়গা সব আবাদ করে ফেলায় খেলাধুলার জায়গা আর অবশিষ্ট নেই, তেমনি জীবিকার তাড়নায় সদাব্যস্ত মানুষের কাছে চিত্তবিনোদন অনেকটা বিলাসিতার মতো। শহরে এক শ্রেণির প্রভাবশালী লোভী মানুষ খালি জায়গা দখল করে বড় বড় দালান ও বহুতল শপিং কমপ্লেক্স তৈরি করছে। [newresultbd.com] ফলে শহরে পার্ক, মাঠ, লেক, ঝিল আর থাকছে না। বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিত্তবিনোদনের সুযোগ অনেকটা সীমিত। গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের সুযোগ-সুবিধার অভাবে দেশের যুবসমাজের আচরণের বিচ্যুতি ঘটছে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ও পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের কারণে সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা প্রভৃতি এবং ভি.সি.পি., ভি.সি.আর. ক্যাসেট প্লেয়ার, এফ.এম. রেডিওসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা গৃহের অভ্যন্তরেই চিত্তবিনোদনের সুযোগ প্রদান করছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রযুক্তির মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা, সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক চিত্তবিনোদনের সুযোগকে অবারিত করেছে। তবে ঐতিহ্যবাহী ঈদ উৎসব, শারদীয় দুর্গোৎসব, গ্রামীণ মেলা এখনো আছে। বাংলা নববর্ষের মেলার সাথে যুক্ত হয়েছে বিজয় মেলা, স্বাধীনতা উৎসব, বাণিজ্যমেলা, বইমেলা ইত্যাদি। বর্তমানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা, নাটক, চলচ্চিত্রসহ শিল্পের সকল শাখার উৎকর্ষ সাধনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করছে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি বইপড়া, খেলাধুলা, ব্যায়াম, ছবি আঁকা, ছবি তোলা, ভ্রমণ, বাগান করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। কিন্তু নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণি বলতে গেলে চিত্তবিনোদনের সুযোগ থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশে চিত্তবিনোদনের বর্তমান অবস্থা সন্তোষজনক নয়।

বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদার অপূরণীয় সমস্যাঃ

১. পুষ্ঠিহীনতা: মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা থেকে সৃষ্ট সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো পুষ্টিহীনতা। সাধারণত খাদ্যে পুষ্টি উপাদানের অভাব, পরিমাণগত স্বল্পতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কারণে সৃষ্ট অবস্থাই হচ্ছে পুষ্টিহীনতা। খাবারের ছয়টি উপাদানের যে কোনো একটি খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকলে বা অনুপস্থিত থাকলে পুষ্টি-প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে দেহে সে উপাদানের ঘাটতিজনিত রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এরূপ অবস্থাকে পুষ্টিহীনতা বলে। পুষ্টিহীনতা বলতে কেবল দুর্বল স্বাস্থ্যকেই বোঝায় না। এটি একটি দৈহিক আপেক্ষিক অবস্থা। 

ক. কাজ করার সামর্থ্যে ব্যাঘাত ঘটা;

খ. দৈহিক গাঠনিক সম্পূর্ণতার অভাব এবং

গ. দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহের মাঝে গরমিল।

বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতার বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। ইইঝ পরিচালিত জরিপ ও জাতীয় পুষ্টি জরিপ অনুসারে এদেশের শতকরা ৫০ জন শিশু পুষ্টিহীন। প্রতিবছর এ কারণে প্রায় ২ লাখ শিশু মারা যায়। শতকরা ১৫ জন শিশু ভিটামিন এ-এর অভাবে অন্ধত্ব ও রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। পুষ্টিহীনতার জন্য ৬০ ভাগ মহিলো রক্তস্বল্পতায় ভোগে এবং অন্য বহু লোক রিকেট, স্কার্ভি, গলগন্ড, বিকলাঙ্গতা, চর্মরোগ, কম বুদ্ধি, খাটো হওয়া প্রভৃতিতে ভোগে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত বিভিন্ন শিশু পুষ্টি জরিপের তথ্য থেকে পুষ্টিহীনতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

২. স্বাস্থ্যহীনতা: শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ঘাটতি বা অভাবজনিত অবস্থাকে স্বাস্থ্যহীনতা বলে। বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা থেকে সৃষ্ট অন্যতম সমস্যা হলো স্বাস্থ্যহীনতা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি মৌলিক মানবিক চাহিদা এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্যের অভাবে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এসব কারণে এ দেশের অনেক মানুষ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে স্বাস্থ্যহীনতার শিকার হয়। প্রয়োজনীয় ও স্বাস্থ্যসম্মত বস্ত্রের সংকটের কারণে বহু লোকের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। শিক্ষার অভাবও স্বাস্থ্যহীনতার জন্য বহুলাংশে দায়ী। শিক্ষার অভাবে মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অজ্ঞ হয়। রোগব্যাধির কারণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যাপারে তারা অজ্ঞ থাকে। ফলে তারা স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, খোলামেলা ও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু পর্যাপ্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান সংকটের কারণে স্বাস্থ্যহানি ঘটে। নির্মল ও গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের অভাবে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে শারীরিক ও মানসিক অবসাদ, হতাশা, চাপ প্রভৃতি দূর করা সম্ভব হয় না। এজন্য তারা সহজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে। সুতরাং দেখা যায়, বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলো প্রত্যাশিত মান অনুযায়ী পূরণ না হওয়ায় স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩. গৃহ ও বস্তি সমস্যা: গৃহ হচ্ছে মানুষের আশ্রয়স্থল। জনসংখ্যার তুলনায় গৃহের সংখ্যা কম। ফলে শহর এলাকায় অনেকেই বস্তিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। বস্তি বলতে এমন এক অবহেলিত জনবসতি এলাকাকে বোঝায়, যেখানে জীবনধারণের ন্যূনতম সুযোগটুকুও থাকে না। অত্যন্ত নিম্ন জীবনমান, পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব, পানীয় জল ও আলো-বাতাসের অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপরাধ প্রভৃতি বস্তি এলাকার নিত্য সঙ্গী যা সমাজকে করে কলুষিত। এ কারণেই বস্তিকে সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ১০ লাখ লোক গৃহহীন। এরা শহর, নগর, বন্দর এবং গ্রাম এলাকায় অস্থায়ী বাসস্থান স্থাপন করে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শিল্প ও শহরাঞ্চলের পাশে অল্প আয়ের লোকেরা গড়ে তোলে ছোট খুপরি ঘর যা বস্তি নামে পরিচিত। বাংলাদেশের শহরগুলোতে বস্তিসমস্যা অত্যন্ত প্রকট। শুধু ঢাকা শহরে ৩৫ শতাংশ লোক বস্তিতে বাস করে। ২০১১ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী এদেশে বস্তির সংখ্যা ছয় হাজার এবং বস্তির লোকসংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ। বস্তির নোংরা ঘিঞ্জি পরিবেশ স্বাস্থ্যহীনতা, সামাজিক সমস্যা ও অনাচারের সূতিকাগার। গৃহের স্বল্পতা ও বস্তির বিস্তারের ফলে স্বাস্থ্যহীনতা, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা, অপরাধ, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস, পতিতাবৃত্তিসহ নানা জটিল সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। গৃহ ও বস্তি সমস্যা দেশের অন্ন-বস্ত্রের সমস্যার সাথে জড়িত। বাংলাদেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থায় অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা মোকাবিলা করার পর বাসস্থানের চাহিদা পূরণের সংগতি অনেকের থাকে না। গৃহ ও বস্তি সমস্যার অপর দিক স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের অভাব। এজন্য জনগণের শিক্ষার অভাব অনেকাংশে দায়ী। নিরক্ষর ও অজ্ঞ জনগণ ঝোপঝাড়ে ঘেরা, আলো-বাতাসহীন ঘর যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তা জানে না বলে ঘরকে ঝুপড়িতে পরিণত করে রাখে।

৪. নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা: নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা মৌলিক মানবিক চাহিদা অপূরণজনিত একটি মারাত্মক সমস্যা। নিরক্ষরতা বলতে অক্ষরজ্ঞানহীন অবস্থা এবং অজ্ঞতা বলতে জ্ঞানের অভাবকে বোঝায়। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র ও সাধারণ বক্তব্যকে উপলদ্ধি সহকারে লিখতে এবং পড়তে অক্ষম ব্যক্তির অবস্থাকে নিরক্ষরতা বলে। বাংলাদেশের শতকরা ৩৮ জন লোক নিরক্ষর। নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার মূলে অন্যান্য উপাদান থাকলেও অপূরিত মৌলিক মানবিক চাহিদার প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। কারণ, শিক্ষার অভাব থেকেই সমাজে নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা দেখা দেয়। একমাত্র শিক্ষাই মানুষকে নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বলে তারা শিক্ষার প্রতি নজর দিতে পারে না। ফলে তারা নিরক্ষর ও অজ্ঞ থাকে। স্বল্প আয়ের লোকেরা বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, চিত্তবিনোদন প্রভৃতি পূরণ করতে পারছে না বলে স্বভাবতই শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ থাকে না। ফলে তারা নিরক্ষর ও অজ্ঞ থেকে যায়। 

৫. অপরাধপ্রবণতা: সমাজের প্রচলিত আইনকানুন, রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী কার্যকলাপকে অপরাধ বলে। অপূরিত মৌলিক মানবিক চাহিদার একটি অপরিহার্য পরিণতি হচ্ছে অপরাধপ্রবণতা। সমাজে বৈধ উপায়ে মানুষ যখন মৌলিক মানবিক চাহিদার একটি অপরিহার্য পরিণতি হচ্ছে অপরাধপ্রবণতা। সমাজে বৈধ উপায়ে মানুষ যখন মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন অবৈধ বা অসামাজিক উপায়ে এগুলো পূরণের চেষ্টা করে। ফলে মানুষের মাঝে স্বভাবতই অপরাধপ্রবণতা দেখা দেয়। অপরাধপ্রবণতার পেছনে বহু কারণ থাকতে পারে। তবে অপূরিত মৌলিক মানবিক চাহিদা সমাজে অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টির একটি শক্তিশালী কারণ। বাংলাদেশে বেশির ভাগ অপরাধই খাদ্যের চাহিদা পূরণ করার জন্য সংঘটিত হয়। বৈধ উপায়ে খাদ্যের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে ক্ষুধার্ত মানুষ চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, লুটতরাজ ইত্যাদি অপরাধের মাধ্যমে খাদ্য জোগাড়ের চেষ্টা করে। আবার শিক্ষার চাহিদা অপূরিত থাকলে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা দিতে পারে। অপরাধীদের মধ্যে নিরক্ষরের সংখ্যাই বেশি। নিরক্ষর মানুষ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, দায়িত্বজ্ঞানের অভাব এবং কুসংস্কারের বশে নানারকম সমাজবিরোধী কাজ করে। এতে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বাসস্থানের অভাব এবং বস্তি সমস্যা বিভিন্নভাবে ব্যক্তিকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। চিত্তবিনোদনের অভাবে জীবন একঘেয়ে ও বিস্বাদ হয়ে ওঠে, সৃষ্টি হয় নিরাশা, হতাশা আর বঞ্চনার যা মানুষকে অনেক সময় অপরাধের দিকে ধাবিত করে। 

মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের উপায়ঃ

১. খাদ্য: বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সার্বিক কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০), জাতীয় কৃষিনীতি ও সহ¯্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে কৃষিখাতের উন্নয়নের সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষি উপকরণে ভর্তূকি বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা, কৃষিঋণের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তি সহজীকরণ করা হয়েছে। মাটির গুণাগুণ বজায় রাখা ও অধিক ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুষম সার ও জৈব সারের ব্যবহার কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে দেশজ খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কৃষিখাতের সার্বিক উন্নয়নকে সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। কৃষিখাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্রসেচ সম্প্রসারণ, জলাবদ্ধতা নিরসন, নিবিড় চাষ, উন্নতমানের ও উচ্চফলনশীল বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ, জমির ব্যবহার বহুধাকরণ, পতিত জমি পুনরুদ্ধার, লবণাক্ত সহিষ্ণু ও স্বল্প সময়ের শস্যের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। 

২. বস্ত্র: বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালের মধ্যে বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং বস্ত্র রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেশের প্রথম বস্ত্রনীতি ঘোষণা করে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ২০০৫ সালের মধ্যে বার্ষিক মাথাপিছু ১৭ মিটার বস্ত্র প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ বস্ত্রের চাহিদা দেশীয় শিল্প থেকে আসে। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে বর্তমানে ৫০ লক্ষাধিক জনবল নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে বন্ধ মিলগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বস্ত্রখাতের উন্নয়নে বস্ত্র প্রযুক্তিবিদ ও বস্ত্রবিষয়ক দক্ষ জনশক্তির চাহিদা পূরণে বস্ত্র দপ্তর ৫টি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ৬টি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট এবং ৪০টি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ রেশম বোর্ড, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বাংলাদেশ সিল্ক ফাউন্ডেশন, পাট অধিদফতর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান বস্ত্রখাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সমাজের দুস্থ ও দরিদ্র শ্রেণির বস্ত্রের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকার পুরাতন কাপড় আমদানিসহ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। 

৩. বাসস্থান: দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গৃহায়ণের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ১৯৯৭-৯৮ সালে গৃহায়ণ তহবিল গঠন করা হয়। এ তহবিল দ্বারা এ পর্যন্ত ৩.৫৫ লক্ষ জন উপকৃত হয়েছে। গৃহনির্মাণ কর্মসূচির আওতায় ফেব্রুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত ৬১,০৯২টি গৃহনির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। সারা দেশে মোট ৫১৩টি এনজিও ৬৪টি জেলার ৪৫০টি উপজেলায় গৃহায়ন ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। শহরাঞ্চলের ভাসমান জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কয়েকটি পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে গ্রহণ করা হয় আশ্রয়ণ প্রকল্প। ১৯৯৭-২০০২ পর্যন্ত সময়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ হাজার পরিবারকে এ প্রকল্পের আওতায় পুনর্বাসন করা হয়। 

৪. শিক্ষা: সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার প্রতিপালনে ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার একটি নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সরকার যুগোপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করেছে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নতুন কারিক্যুলাম প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনহ নানাবিধ উন্নয়ন ও সংস্কারধর্মী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,০৮,৫৩৭টি। প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্রছাত্রী ভর্তির সংখ্যা ও হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি এবং বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১,৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের ২৬,১৯৩টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং কর্মরত শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত সময়ে ৫৫৫টি সরকারি এবং ৭৭টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কার করা হয়েছে। সরকার বছরের শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করছে। 

৫. স্বাস্থ্য: সরকারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা হলো সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা উপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় শিশুদের মারাত্মক ছয়টি রোগ:ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, পোলিও, হুপিং কফ, যক্ষা ও হাম প্রতিরোধের জন্য ১৯৭৯ সাল থেকে টিকাদান কর্মসূচি চালু রয়েছে। দেশকে পোলিওমুক্ত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী জাতীয় টিকাদান দিবস পালিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। মাঠকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, যক্ষা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ এবং ভিটামিন ‘এ’র অভাবজনিত অন্ধত্ব দূরীকরণ, কৃমিনাশক ঔষুধ বিতরণ ও টিকাদান ইত্যাদি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ, পরিবারকল্যাণ, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচিকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১১-১৬ মেয়াদে ৫৬,৯৩৩.৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের জন্য এ পর্যন্ত ৩,৮৮১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র, ১২৮১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ৪২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে। 

জীবনমান উন্নয়নের যৌক্তিকতাঃ 

‘উন্নয়ন’ কথাটি সকল ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্থে প্রয়োগ করা হয়। জীবনমান উন্নয়ন বলতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবন-যাত্রার মানের উন্নয়ন, মানব সম্পদের বিকাশ, কাম্যজনসংখ্যা, পরিবেশ ও সামাজিক খাতের পূর্বাবস্থা থেকে অপেক্ষাকৃত উন্নততর অবস্থার পরিবর্তনকে বোঝায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনমান, আয়ুস্কাল, মানবসম্পদ ইত্যাদি খাতে একটা দেশ উন্নয়নের কোন অবস্থান করছে তার চিত্র জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে পাওয়া যায়।

মনীষীগণ জীবনমান উন্নয়নকে পরিকল্পিত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, “জীবনমান উন্নয়ন হলো গতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমগ্র জনগোষ্ঠীর মঙ্গলজনক অবস্থার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত সামাজিক পরিবর্তন আনয়নের প্রক্রিয়া।” উন্নয়ন প্রসঙ্গে ম্যাকাইভার ও পেজ বলেন, “জীবদেহের উন্নয়ন হলো তার জীবনের উন্নতি, আর জীবনমান উন্নয়ন হলো তার সভ্যদের মধ্যে যে জীবন আছে তার উন্নতি। তাই ব্যক্তিকে কোনভাবেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলে না।” ‘জীবনমান উন্নয়ন’ প্রত্যয়টিকে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, শিল্প বিস্তারের পর থেকে সমবায়

আন্দোলন, সামাজিক কর্ম ও কমিউনিটি উৎপাদন। দ্বিতীয়ত, আধুনিকীকরণের সমার্থক হিসেবে, তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে সমাজের উন্নয়ন ভাবনা। ষাটের দশক থেকে জীবনমান উন্নয়ন প্রত্যয়টি ব্যবহার হচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, দাতাসংস্থা, এনজিও প্রভৃতি প্রত্যয়টির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অতএব জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত। 

Get HSC Social Work Assignment Answer

[Join]