যেখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা করা হয় তাকে পরীক্ষাগার বা গবেষণাগার (Laboratory) বলে। তাই যেখানে রসায়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণা করা হয় তাকে রসায়ন পরীক্ষাগার বা রসায়ন গবেষণাগার (Chemistry Laboratory) বলে। রসায়ন গবেষণাগারে থাকবে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। প্রায় প্রত্যেকটি রাসায়নিক দ্রব্যই আমাদের জন্য অথবা পরিবেশের জন্য কম-বেশি ক্ষতিকর। কোনো রাসায়নিক দ্রব্য বিস্ফোরক জাতীয়, কোনো রাসায়নিক দ্রব্য দাহ্য (সহজেই যাতে আগুন ধরে যায়), কোনোটি আমাদের শরীরের সরাসরি ক্ষতি করে আবার কোনোটি পরিবেশের ক্ষতি করে। রসায়ন পরীক্ষাগারে যে যন্ত্রপাতি বা পাত্র ব্যবহার করা হয় তার বেশির ভাগই কাচের তৈরি। তাই এ রসায়ন পরীক্ষাগারে ঢোকা থেকে শুরু করে বের হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অসতর্ক হলেই যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেমন— এসিড গায়ে পড়লে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হবে। পোশাকে পড়লে পোশাকটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া রসায়ন গবেষণাগারে অগ্নিকাণ্ড বিস্ফোরণসহ নানা ধরনের ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই শরীরকে রক্ষা করতে পরতে হবে নিরাপদ পোশাক বা অ্যাপ্রোন (apron)। রসায়ন গবেষণাগারে ব্যবহৃত অ্যাপ্রোনের হাতা হবে হাতের কবজি পর্যন্ত আর লম্বায় তোমার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত। এটি হয় সাদা রঙের। হাতকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ববহৃত হয় হ্যান্ড গ্লাভস। চোখকে রক্ষা করার জন্য সেফটি গগলস ব্যবহার করা হয়।
পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য সমূহকে সাধারণভাবে ভৌত অবস্থার ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়। কঠিন ও তরল রাসায়নিক দ্রব্যটিকে অতি উন্নত মানের প্লাস্টিক বা কাঁচের পাত্রে রাখা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পাত্রের মুখ বা ঢাকনা যেন ধাতব না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। গ্যাসীয় পদার্থ সমূহ নিশ্ছিদ্র ধাতব সিলিন্ডারে ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের রাসায়নিক ধর্ম উল্লেখপূর্বক লেবেল পাত্রের গায়ে লাগানো উচিত। যেমন- দাহ্য দ্রব্য (ইথার, অ্যালকোহল, পারঅক্সাইড ইত্যাদি), ক্ষয়কারী দ্রব্য (বিভিন্ন এসিড ও ক্ষার), বিষাক্ত পদার্থ (ডিডিটি, ক্লোরোবেনজিন, সায়ানাইড জাতীয় লবণ ইত্যাদি), অতি সক্রিয় দ্রব্য (সোডিয়াম, পটাশিয়াম, পিকরিক এসিড ইত্যাদি)।
এক কথায় বলা যায়, ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য কে বিক্রিয়া করে না এমন পদার্থের কোন পাত্রের গায়ে উপযুক্ত সতর্কবাণী নির্দেশিত লেবেলসহ বায়ুনিরোধী অবস্থায় রাখা উচিত, যা ওই রাসায়নিক দ্রব্যের সর্বোচ্চ নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করে।
ল্যাবরেটরীতে ব্যবহৃত ও উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু নিয়ম অনুসরণ করা হয় যথা-
১. মেয়াদ উত্তীর্ণ ব্যবহৃত বা উৎপন্ন নমুনা যদি এক হয় তবে অপেক্ষাকৃত পরিবেশবান্ধব ক্ষারীয় উপাদান সোডিয়াম কার্বনেট দ্বারা অ্যাসিড কে প্রশমিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
২. অব্যবহৃত উৎপাদ বা উপজাত অত্যন্ত ক্ষতিকারক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশঝুঁকির কারণ হলে এদের অপচনশীল পলিথিনে প্যাকেট করে অপেক্ষাকৃত কিছুটা গভীরে পুঁতে রাখতে হবে।
৩. কম ঝুঁকিপূর্ণ নমুনা যা সহজে পানিতে দ্রবীভূত হয় এরূপ নমুনা কে অত্যন্ত লঘু করে পানি প্রবাহে ধুয়ে নিতে হবে। কারণ লঘু নমুনা তেমন কোনো ক্ষতি করে না।
৪. অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাজ সম্পন্ন করা, যাতে বর্জ্য কম উৎপন্ন হয় এবং রাসায়নিক ব্যবহার কম হয়।
৫. উৎপন্ন উপজাত অম্লীয় বা ক্ষারীয় হলে প্রশমিত করে ড্রেনেজ করা।
৬. সোডিয়াম ধাতুকে নষ্ট করতে অ্যালকোহল ব্যবহার করতে হবে।
৭. অব্যবহৃত লিথিয়াম অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রেট সোডিয়াম সালফেট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট দ্বারা প্রশমিত করে নিতে হবে।
৮. ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। ভারী বস্তু অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিষাক্ত গ্যাস কে প্রশমিত করে পরিবেশ দূষণমুক্ত করতে হবে।
ল্যাবরেটরীতে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থসমূহ তরল, বায়বীয় হতে পারে। এদের অনেকগুলো বিষাক্ত, দাহ্য এবং দেহ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক, তাই এই নমুনা গুলোকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হয়। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নমুনা নামের কৌটা, বোতলগুলো কে ম্যাটেরিয়াল সেফটি অ্যান্ড ডাটাশিট অনুসারে সাজাতে হবে। পরীক্ষার প্রথম নমূনা ব্যবহারে সাবধানতা করতে হবে। কেননা প্রয়োজনের অতিরিক্ত নমুনা ব্যবহার করা উচিত নয়। পরীক্ষা শেষে অতিরিক্ত অবিকৃত রাসায়নিক উপাদান কে পুনরায় গুরুত্বসহকারে সংরক্ষণ করতে হবে। রাসায়নিক নমুনাগুলো যেসব কৌটা, বোতল, বিকার প্রভৃতিতে রেখে কাজ করা হয়, সেগুলোর গায়ে নমুনার নাম, ঘনমাত্রা, সংরক্ষণের তারিখ ও সম্ভাব্য ঝুঁকি প্রতীক ব্যবহার করা আবশ্যক। রাসায়নিক দ্রব্য গুলোকে তাদের বৈশিষ্ট্য অনুসারে দাহ্য উপাদানের জন্য আলাদা স্থান, টক্সিকের জন্য আলাদা স্থান, উদ্বায়ী নমুনার জন্য আলাদা স্থান এভাবে সাজাতে হবে। ট্যানারি শিল্পে ব্যবহৃত ভারী বস্তু ও বর্জ্য থাকে, যা মানবদেহে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ল্যাবরেটরীতে ব্যবহৃত ও উৎপাদিত বর্জ্যকে তাদের রাসায়নিক ধর্মের উপর ভিত্তি করে ক্ষয়কারী, দাহ্য, বিষাক্ত, তেজস্ক্রিয় প্রভৃতি শ্রেণীতে ভাগ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রিন কেমিস্ট্রির মূলনীতি অনুসরণ করলে ভালো হয়।
ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের পরিত্যাগ:
রাসায়নিক দ্রব্য ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করার পর ওই নমুনাগুলো অবশিষ্টাংশ ও উৎপাদ উভয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে। তাই সবসময় পরীক্ষণে যত কম সম্ভব কেমিক্যাল ব্যবহার করা এবং উৎপন্ন বর্জ্য ও বিষাক্ত বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ করা যায় ততই ভালো। ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান সমূহকে নিম্নোক্ত উপায় পরিত্যাগ করা যায়।
১. রিসাইক্লিং
২. পুড়িয়ে ফেলা
৩. সুনির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করা
৪. রাসায়নিকভাবে প্রশমিত করা
৫. প্রক্রিয়াজাত ও লঘুকরণ এর মাধ্যমে ড্রেনে ফেলা।
অপেক্ষাকৃত কম বর্জ্য উৎপন্ন হয় এরূপ প্রক্রিয়া বা সবুজ রসায়ন এর নীতি অনুসরণের মাধ্যমে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের পদ্ধতি প্রয়োগ করা। উৎপন্ন বর্জকে রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে নতুন নতুন প্রোডাক্ট উৎপন্ন করা। একবার বা বারবার রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে প্লাস্টিক, কাচ, ডিস্ট্রিলারিজ পেট্রোকেমিক্যাল, রং, ফার্টিলাইজার বর্জ্য প্রভৃতি রিসাইক্লিং করে পরিবেশকে সংরক্ষিত রাখা যায়।
ক্লিনিক ও হাসপাতালের বর্জ্য মানুষ, ১ প্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হওয়ায় তা প্যাকেটজাতকরণ এর পর পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
যেকোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের আগেই আমাদের জেনে নিতে হবে সে রাসায়নিক দ্রব্যটি কোন প্রকৃতির। সেটি কি বিস্ফোরক অথবা দাহ্য নাকি তেজস্ক্রিয়। সেটি বোঝানোর জন্য রাসায়নিক পদার্থের বোতল বা কৌটার লেবেলে এক ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। এ সংক্রান্ত একটি সর্বজনীন নিয়ম (Globally Harmonized System) চালুর বিষয়কে সামনে রেখে জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিবেশ ও উন্নয়ন নামে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বিভিন্ন পদার্থের ঝুঁকি এবং ঝুঁকির মাত্রা বোঝানোর জন্য সর্বজনীন সাংকেতিক চিহ্ন নির্ধারণ করা হয়।
নিচে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন এবং সাংকেতিক চিহ্নবিশিষ্ট পদার্থের যে সকল ঝুঁকি, ঝুঁকির মাত্রা ও সাবধানতা বোঝানো হয় তা দেওয়া হলো।
বিস্ফোরক পদার্থ: এ চিহ্নবিশিষ্ট পদার্থ থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। এসব পদার্থ ব্যবহারের সময় মনে রাখতে হবে এসব পদার্থে আঘাত লাগলে বা আগুন লাগলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হতে পারে, যার জন্য শরীরের এবং গবেষণাগারের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই এ দ্রব্যগুলো খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। টিএনটি, জৈব পার-অক্সাইড, | নাইট্রোগ্লিসারিন ইত্যাদি এ ধরনের বিস্ফোরক পদার্থ।
দাহ্য পদার্থ: অ্যালকোহল, ইথার ইত্যাদি দাহ্য পদার্থ। এসব পদার্থে দ্রুত আগুন ধরে যেতে পারে। তাই এদের আগুন বা তাপ থেকে সব সময় দূরে রাখতে হবে।
বিষাক্ত পদার্থ: এ চিহ্নধারী পদার্থ বিষাক্ত প্রকৃতির। তাই শরীরে লাগলে বা শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে শরীরের নানা ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। বেনজিন, ক্লোরোবেনজিন, মিথানল এ ধরনের পদার্থ। এ ধরনের পদার্থ ব্যবহারের সময় অ্যাপ্রোন, হ্যান্ড গ্লাভস, সেফটি গগলস ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
উত্তেজক পদার্থ: সিমেন্ট ডাস্ট, লঘু এসিড, ক্ষার, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি উত্তেজক পদার্থ ত্বক, চোখ, শ্বাসতন্ত্র ইত্যাদির ক্ষতি করে। তাই এ ধরনের পদার্থ ব্যবহারের সময় অ্যাপ্রোন, হ্যান্ড গ্লাভস, সেফটি গগলস এগুলো ব্যবহার করতে হবে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ: এ ধরনের পদার্থ ত্বকে লাগলে বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে শরীরের ভেতরে গেলে শরীরের স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিসাধন করে। এগুলো শরীরের মধ্যে গেলে ক্যানসারের মতো কঠিন রোগ হতে পারে কিংবা শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এ ধরনের পদার্থের উদাহরণ হলো বেনজিন, টলুইন, জাইলিন ইত্যাদি। তাই এগুলোকে সতর্কভাবে রাখতে হবে এবং ব্যবহারের সময় অ্যাপ্রোন, হ্যান্ড গ্লাভস, সেফটি গগলস এগুলো পরে নিতে হবে।
তেজস্ক্রিয় পদার্থ: এসব পদার্থ থেকে ক্ষতিকারক রশ্মি বের হয় যা ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে কিংবা একজনকে বিকলাঙ্গ করে দিতে পারে। তাই এসব পদার্থ ব্যবহারের সময় বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যেমন– ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর: এ চিহ্নধারী পদার্থগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। অর্থাৎ উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক। এ ধরনের পদার্থের উদাহরণ হলো লেড, মার্কারি ইত্যাদি। তাই এগুলোকে ব্যবহারের সময় যথেষ্ট সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আবার, ব্যবহারের পরে যেখানে-সেখানে না ফেলে তা একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। এসব পদার্থকে যথাসম্ভব পুনরুদ্ধার করে আবার ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে এগুলো সহজে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারবে না।
ক্ষত সৃষ্টিকারী: এ চিহ্নধারী পদার্থ শরীরে লাগলে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করে। শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করলে তা শরীরের ভেতরের অঙ্গেরও ক্ষতিসাধন করতে পারে। হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সালফিউরিক এসিড, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের ঘন দ্রবণ এ জাতীয় পদার্থের উদাহরণ।
উপরোক্ত সতর্কতাগুলো অবলম্বন করতে পারলে রসায়ন পরীক্ষাগারে ছোট-বড় যেকোনো দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।