গ্রিক সভ্যতা ও রোমান সভ্যতার তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন পূর্বক বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতিতে উভয় সভ্যতার অবদান মূল্যায়ন। এসএসসি ২০২১ ইতিহাস চতুর্থ সপ্তাহের এসাইনমেন্ট সমাধান।
গ্রিক সভ্যতা ও রোমান সভ্যতার তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন পূর্বক বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতিতে উভয় সভ্যতার অবদান মূল্যায়ন
ক. পটভূমির ব্যাখ্যা
গ্রিক সভ্যতা: গ্রীষ্মের মহাকবি হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ মহাকাব্য দুটিতে বর্ণিত চমকপ্রদ কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যকে খুঁজে বের করার অদম্য ইচ্ছা উৎসাহিত করে তোলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের। উনিশ শতকের শেষে হোমারের কাহিনী আর কবিতায় তা সীমাবদ্ধ থাকেনা, বেরিয়ে আসে এর ভিতরের সঠিক ইতিহাস। ইজিয়ান সাগর দ্বীপপুঞ্জ এবং এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলে আবিষ্কৃত হয় উন্নত এক প্রাচীন নগর সভ্যতা। সন্ধান মেলে মহাকাব্যের ট্রয় নগরীসহ একশ নগরীর ধ্বংসস্তূপের। যাকে বলা হয় ইজিয়ান সভ্যতা বা প্রাক-ক্লাসিক্যাল গ্রিক সভ্যতা। ক্রিট দ্বীপ, গ্রীস উপদ্বীপের মূল ভূখণ্ড, এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলে এবং ইজিয়ান সাগর এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ নিয়ে গড়ে ওঠে এই সভ্যতা। এই সভ্যতার অধিবাসীরা ছিল সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের অধিকারী।
রোমান সভ্যতা: গ্রিসের সভ্যতার অবসান এর আগেই ইতালিতে টাইবার নদীর তীরে একটি বিশাল সাম্রাজ্য ও সভ্যতা গড়ে ওঠে। রোমকে কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা রোমান সভ্যতা নামে পরিচিত। প্রথম দিকে রোম একজন রাজার শাসনাধীন ছিল। এসময় একটি সভা ও সিনেট ছিল। রাজা স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ রোমে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রোমান সভ্যতা প্রায় ৬০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল।
খ. ভৌগলিক অবস্থান ও সময়কালের সাদৃশ্য/ বৈসাদৃশ্য উপস্থাপন
গ্রিক সভ্যতা: গ্রিক দেশটি আড্রিয়াটিক সাগর, ভূমধ্যসাগর ও ইজিয়ান সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। গ্রীক সভ্যতার সঙ্গে দুইটি সংস্কৃতির নাম জড়িত। একটি ‘হেলেনিক’ আর অপরটি ‘হেলেনিস্টিক’। গ্রিক উপদ্বীপের প্রধান শহর এথেন্স কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘হেলেনিক সংস্কৃতি’। অপরদিকে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার এর নেতৃত্বে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া কে কেন্দ্র করে গ্রিক ও অগ্রিক সংস্কৃতির মিশ্রণে জন্ম হয় নতুন এক সংস্কৃতির। ইতিহাসে এ সংস্কৃতি ‘হেলেনস্টিক সংস্কৃতি’ নামে পরিচিত।
রোমান সভ্যতা: ইতালির মাঝামাঝি পশ্চিমাংশে রোম নগর অবস্থিত। ইতালির দক্ষিনে ভূমধ্যসাগর থেকে উত্তর দিকে আল্পস পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত। ইতালি ও যুগোস্লাভিয়ার মাঝখানে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর। আড্রিয়াটিক সাগর তীরে ইতালির উত্তর-পূর্ব অংশে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সমুদ্র বন্দর এড্রিয়া। ইতালির পশ্চিমাংশেও ভূমধ্যসাগর অবস্থিত। সাগরের অংশকে প্রাচীনকালে বলা হতো এটুস্কান সাগর। কৃষি বিকাশের সুযোগ ছিল বলে প্রাচীন রোম ছিল কৃষি নির্ভর দেশ। ফলে রোমের আদি অধিবাসীদের সঙ্গে অনুপ্রবেশকারীদের সংঘর্ষ সাধারণ বিষয় ছিল। যে কারণে এসব সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে রোমানরা যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হতে থাকে। রোমান ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নানা উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ৭৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম নগরী প্রতিষ্ঠা হয় এবং ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মান বর্বর জাতি গুলোর হাতে রোমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন হয়।
গ. শিক্ষা, সাহিত্য ও দর্শনের তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য
গ্রিক সভ্যতা
শিক্ষা: শিক্ষা সম্পর্কে গ্রিক জ্ঞানীগুণীরা বিভিন্ন ধারণা পোষণ করতেন। তারা নৈতিক ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ মনে করতেন সুশিক্ষিত নাগরিকের হাতে শাসনভার দেওয়া উচিত। সরকারের চাহিদা ও লক্ষ্য অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিত। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল আনুগত্য ও শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়া। স্বাধীন গ্রীসবাসিদের মধ্যে ছেলেরা সাত বছর বয়স থেকে পাঠশালায় যাওয়া-আসা করত। ধনী ব্যক্তিদের ছেলেদের ১৮ বছর পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারতো। কারিগরি আর কৃষকের ছেলেরা প্রাথমিক শিক্ষা পেত। দাসদের সন্তানদের জন্য বিদ্যালয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। মেয়েরাও কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারত না।
সাহিত্য: সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিসের সৃষ্টি আজও মানবসমাজে মূল্যবান সম্পদ। হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ মহাকাব্য তার অপূর্ব নিদর্শন। সাহিত্য ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল নাটক রচনায়। বিয়োগান্ত নাটক রচনায় গ্রীকরা বিশেষ পারদর্শী ছিল। এস্কাইলাস কে এই ধরনের নাটকের জনক বলা হয়। তাঁর রচিত নাটকের নাম ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’। গ্রিসের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ছিলেন সফোক্লিস। তিনি ১০০ টিরও বেশি নাটক রচনা করেন। তার বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রাজা ইডিপাস, আন্তিগোনে ও ইলেকট্রী অন্যতম। আর একজন বিখ্যাত নাট্যকার এর নাম ইউরিপিদিস। এরিস্টোফেনিস এর মিলনাত্মক ও ব্যঙ্গ রচনায় বিশেষ খ্যাতি ছিল। ইতিহাস রচনায়ও গ্রিকরা কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। হেরোডোটাস ইতিহাসের জনক নামে পরিচিত ছিলেন। হেরোডোটাস রচিত ইতিহাস সংক্রান্ত প্রথম বইটি ছিল গ্রিক ও পারস্যের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে। থুকিডাইডেন্স ছিলেন বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের জনক। তার বইটির শিরোনাম ছিল দা পেলোপন্নেশিয়ান ওয়র।
দর্শন: দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে গ্রিসে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল। পৃথিবী কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিদিন কিভাবে এর পরিবর্তন ঘটছে- এসব ভাবতে গিয়ে গ্রিসে দর্শন চর্চার সূত্রপাত। থালেস ছিলেন প্রথম দিককার দার্শনিক। তিনিই প্রথম সূর্য গ্রহণের প্রাকৃতিক কারণ ব্যাখ্যা করেন। এরপর গ্রীষ্মে যুক্তিবাদী দার্শনিক এর আগে ঘটে। ভাঁদের বলা সাফিস্ট। তারা বিশ্বাস করতেন যে, চূড়ান্ত সত্য বলে কিছু নেই। পেরিক্লিস তাদের অনুসারী ছিলেন। সক্রেটিস ছিলেন এ দর্শকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান। তার শিক্ষার মূল দিক ছিল আদর্শ রাষ্ট্র ও সৎ নাগরিক গড়ে তোলা। অন্যায় শাসনের প্রতিবাদ করার শিক্ষাও তিঁনি দেন। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো গ্রীক দর্শনকে চরম উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টোটল একজন বড় দার্শনিক ছিলেন।
রোমান সভ্যতা
শিক্ষা: এ সময়ে শিক্ষা বলতে বুঝাতে খেলাধুলা ও বিরোধের স্মৃতিকথা বর্ণনা করা। যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে রুম এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। সুতরাং তাদের সবকিছুই ছিল যুদ্ধ কে কেন্দ্র করে। তারপরও উচ্চ শ্রেণীভূক্ত রোমানদের গ্রিক ভাষা শিখা ছিল একটি ফ্যাশন। রোমানদের অনেকেই গ্রিক সাহিত্যকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ করার দক্ষতা অর্জন করে। রোমের অভিজাত যুবকরা গ্রিসের বিভিন্ন বিখ্যাত বিদ্যাপীঠে শিক্ষা লাভ করতে যেত।
সাহিত্য: সে যুগের সাহিত্যে অবদানের জন্য পুটাস ও টেরেন্সর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা দুজন মিলনাত্মক নাটক রচনার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নতি দেখা যায় আগাস্টাস সিজারের সময়। এ যুগের কবি হোরাস ও ভার্জিল যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ভার্জিলের মহাকাব্য ইলিয়াড বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। অভিদ ও লিভি এযুগের খ্যাতনামা কবি।
দর্শন: অনেকেই মনে করেন যে, রোমীয় দর্শন গ্রীক দর্শন এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তবুও রোমান দর্শনে সিসেরো, লুক্রেটিয়াস (খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৯৮-৫৫) তাঁদের সুচিন্তিত দার্শনিক মতবাদ দ্বারা অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। রুমে স্টোইকবাদী দর্শন যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। ১৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ রোডস দ্বীপের প্যানেটিয়াস এই মতবাদ রোমে প্রথম প্রচার করেন।
ঘ. স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষ উপস্থাপন
গ্রিক সভ্যতা
স্থাপত্য: গ্রীক শিল্পের বিশেষ করে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের উন্নতি হয়েছিল। গ্রিক চিত্র শিল্পের নিদর্শন মৃৎপাত্রের আঁকা চিত্রের মধ্যে দেখা যায়। স্থাপত্যের সুন্দর সুন্দর নিদর্শন গ্রিসের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। বড় বড় স্তম্ভের উপর তারা প্রাসাদ তৈরি করত। আর প্রাসাদের স্তম্ভগুলো থাকতো অপূর্ব কারুকার্যখচিত। পার্থেনন মন্দির বা দেবী এথেনার মন্দির স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন। এথেন্সের অ্যাক্রপলিস স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শনের ভগ্নাবশেষ এখনো চোখে পড়ে।
ভাস্কর্য: গ্রিক ভাস্কর্য পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগের জন্ম দিয়েছিল। সে যুগের প্রখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী ছিলেন মাইরন, ফিদিয়াস ও প্রাকসিটেলেস।
বিজ্ঞান: গ্রীকরা প্রথম বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত করে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পৃথিবীর মানচিত্র প্রথম অংকন করেন বিজ্ঞানীরা। তারাই প্রথম প্রমাণ করেন যে, পৃথিবী একটি গ্রহ এবং তার নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হয়। গ্রিক জ্যোতির্বিদরা সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের কারণ নির্ণয় করতে সক্ষম হন। চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। বস্ত্র ও বিদ্যুৎ জিউসের ক্রোধের কারণে নয়, প্রাকৃতিক কারণে ঘটে- এই সত্য তারাই প্রথম আবিষ্কার করেন। জ্যামিতির পন্ডিত ইউক্লিড পদার্থ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। বিখ্যাত গণিতবিদ পিথাগোরাস ও চিকিৎসক বিজ্ঞানী হিপোক্রেটসের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।
রোমান সভ্যতা
স্থাপত্য: রোমান স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর বিশালতা। সম্রাট হার্ডিয়ান এর তৈরি ধর্ম মন্দির প্যান্থিয়ন রোমানদের স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। ৮০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট টিটাস কর্তৃক নির্মিত কলোসিয়াম নাট্যশালা নির্মিত হয়, যেখানে একসঙ্গে ৫৬০০ দর্শক বসতে পারত।
ভাস্কর্য: স্থাপত্যকলার পাশাপাশি রোমান ভাস্কর্যেরও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। রোমান ভাস্কর্যগণ দেব-দেবী, সম্রাট, দৈত্য, পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের মূর্তি তৈরি করতেন মার্বেল পাথরের।
বিজ্ঞান: কলোসিয়াম বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে প্লিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশ্বকোষ প্রণয়ন করেন। এতে প্রায় পাঁচশ বিজ্ঞানীর গবেষণাকর্ম স্থান পেয়েছে। তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবদান ছিল। বিজ্ঞানী সেলসাস চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর বই লেখেন। এছাড়াও চিকিৎসা শাস্ত্রে গালেন রুফাসে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
সুতরাং আমরা বলতে পারি বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতিতে উভয় সভ্যতার অবদান অনস্বীকার্য।
Get SSC History of Bangladesh and World Civilization Assignment Answer