আইন, স্বাধীনতা ও সাম্যের পারস্পরিক সম্পর্ক কীভাবে মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে প্রভাবিত করে- বিশ্লেষণ কর।
মূল্যবােধের ধারণা
যে চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে মূল্যবােধ বলা হয়। সমাজজীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড যে সকল নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবােধ বলে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে মূল্যবােধের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
স্টুয়ার্ট সি.ডড বলেন, “সামাজিক মূল্যবােধ হলাে সে সব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির নিকট হতে লাভ করে”।
এইচ. ডি. স্টেইন- এর মতে, “জনসাধারণ যার সম্বন্ধে আগ্রহী, যা তারা কামনা করে, যাকে তারা অত্যাবশ্যক বলে মনে করে, যার প্রতি তাদের | অগাধ শ্রদ্ধা এবং যা সম্পাদনের মাধ্যমে তারা আনন্দ উপভােগ করে তাকেই মূল্যবােধ বলে”।
এম. আর. উইলিয়াম- এর মতে, “মূল্যবােধ মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদণ্ড, এর আদর্শে মানুষের আচার-ব্যবহার ও রীতি-নীতি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এই মানদণ্ডে সমাজে মানুষের কাজের ভালাে-মন্দ বিচার করা হয়”।
এম. ডব্লিউ. পামফ্রে-এর মতে, “মূল্যবােধ হচ্ছে ব্যক্তি বা সামাজিক দলের অভিপ্রেত ব্যবহারের সুবিন্যস্ত প্রকাশ”। নিকোলাস রেসার -এর মতে, “সামাজিক মূল্যবােধ সেসব গুণাবলি, যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশকে মূল্যবান মনে করে খুশি হয়”।
সুতরাং সামাজিক মূল্যবােধ হচ্ছে সেসব আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের সমষ্টি যা সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে এবং সমাজজীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠা করে। সামাজিক মূল্যবােধ হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবােধ, শৃঙ্খলাবােধ, সৌজন্যবােধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা মানবীয় গুণাবলির সমষ্টি।
নৈতিকতার ধারনা
নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Morality। Morality শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘Moralitas’ থেকে যার অর্থ সঠিক আচরণ। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল সর্বপ্রথম নৈতিকতার প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেন। সক্রেটিস বলেছেন, সৎ গুণই জ্ঞান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা অন্যায় করতে পারেন না এবং ন্যায় বােধের উৎস হচ্ছে জ্ঞান এবং অন্যায় বােধের উৎস হচ্ছে অজ্ঞতা। পরবর্তীতে রােমান দার্শনিকরা প্রথাগত আচরণ অর্থে “mas’ কথাটি ব্যবহার করেন। ল্যাটিন। এই ‘mas’ শব্দ থেকেই Morals ও Morality (নৈতিকতা) শব্দের উদ্ভব ঘটেছে। জোনাথন হেইট মনে করেন, “ধর্ম, ঐতিহ্য এবং মানব আচরণ এই তিনটি থেকেই নৈতিকতার উদ্ভব হয়েছে। নীতিবিদ মুর বলেছেন, “শুভর প্রতি অনুরাগ ও অশুভর প্রতি বিরাগই হচ্ছে নৈতিকতা”।
আইন,স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারনা
আইনের ধারণাঃ আইনের সাধারণ অর্থ হলাে নিয়ম-কানুন বা বিধি-বিধান। ফার্সি আইন শব্দটির অর্থ সুনির্দিষ্ট নীতি বা নিয়ম। আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ Law, এর অর্থ স্থির বা অপরিবর্তনীয় এবং সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযােজ্য। সমাজের আইন কানুনও স্থির। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, দিবা-রাত্রি, জোয়ার-ভাটা সবই স্থির নিয়মের অধীন। সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থায় এক নিয়মের রাজত্ব বিরাজমান। এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানাের ক্ষমতা কারাে নেই। সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতাে রাষ্ট্রও একটি প্রতিষ্ঠান। সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সমাজজীবনে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সুস্থ রাষ্ট্রীয় জীবনযাপনের জন্য মানুষকে কিছু কিছু বিধি-নিষেধ ও নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। এসব বিধিনিষেধ বা নিয়ম-কানুনকে আইন বলে। সুতরাং আইন হচ্ছে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নিয়মের সমষ্টি যা সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত।
টমাস হবস এর মতে, “জনগণের ভবিষ্যৎ কার্যাবলি নিদিষ্ট করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ যে আদেশ প্রদান করে তাই আইন”।
অধ্যাপক হল্যান্ড-এর মতে, “আইন হচ্ছে, সেই সাধারণ নিয়ম যা মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যা প্রয়ােগ করেন। জন অস্টিন বলেন, “আইন হচ্ছে নিম্নতমের প্রতি উধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আদেশ”।
আইনের উৎস- জন অস্টিনের মতে, আইনের উৎস একটি এবং তা হচ্ছে সার্বভৌমের আদেশ। তবে অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে, আইনের উৎস হলাে ছয়টি।
যথাঃ
(১) প্রথা
(২) ধর্ম
(৩) বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত
(৪) বিজ্ঞানসন্মত আলােচনা
(৫)ন্যায়বােধ
(৬) আইন পরিষদ।
১. প্রথাঃ প্রথা হলাে আইনের একটি সুপ্রাচীন উৎস। প্রাচীনকাল থেকে যেসব আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি ও অভ্যাস সমাজে অধিকাংশ জনগণ কর্তৃক সমর্থিত, স্বীকৃত ও পালিত হয়ে আসছে, তাকে প্রথা বলে। প্রাচীনকালে কোনাে আইনের অস্তিত্ব ছিল না। তখন প্রচলিত প্রথা, অভ্যাস ও রীতিনীতির সাহায্যে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হতাে। কালক্রমে অনেক প্রথাই রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে আইনের মর্যাদা অর্জন করে।
২. ধর্মঃ ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগ্রন্থ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের জীবনবােধের খুব গভীরে নিহিত থাকায় অনেক বিধি-নিষেধ ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এ সমস্ত ধর্মীয় বিধিবিধানসমূহ রাষ্ট্রীয় সমর্থন লাভ করে পরে আইনে পরিণত হয়। মুসলিম আইন প্রধানত কুরআন ও সুন্নাহর ওপর নির্ভরশীল। পারিবারিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনগুলাে মলত ধর্ম থেকে এসেছে।
৩. বিচারালয়ের সিদ্ধান্তঃ বিচারকরা দেশের প্রচলিত আইন অনুন্সগঞ্জে বিদ্যা। কাজ পরিচালনা করে থাকেন। অস্পষ্ট শব্দগত ব্যাখ্যার কারণে অথবা পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে বিচারকরা যখন দেশে বিরাজমান আইন দ্বারা মামলা মকদ্দমার নিস্পত্তি করতে সমর্থ হন না, তখন তারা নিজেদের বিবেক, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা থেকে নতুন নতুন আইন সৃষ্টি করেন এবং প্রয়ােজনবােধে আইনের যথার্থর্তা বিশ্লেষণ করেন। পরবর্তীতে এসব বিচারক প্রণীত আইন অন্যান্য বিচারকগণ কর্তৃক ব্যাপকভাবে অনুসৃত হতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারপতি মার্শাল, হিউজেস প্রমুখ বিচারক এভাবে বহু নতুন আইন সৃষ্টি করেছেন।
৪. বিজ্ঞানসম্মত আলােচনাঃ প্রখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞদের মূল্যবান আলােচনা, বিশ্লেষণ এবং লিখিত গ্রন্থসমূহ আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। বিচারকরা যখন কোনাে বিতর্কিত জটিল বিষয়ে আইনজ্ঞদের এসব মতামত গ্রহণ করেন তখন তা প্রচলিত আইনের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ ইমাম আবু হানিফার ব্যাখ্যা, হেদায়া-ই-আলমগিরি প্রভৃতি গ্রন্থ ইসলামি আইনের ব্যাখ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ন্যায়বােধঃ আইন নির্দিষ্ট ও স্থিতিশীল বিধান। কিন্তু সমাজজীবন পরিবর্তনশীল ও গতিময়। দেশে প্রচলিত আইন যখন যুগােপযােগী বিবেচিত হয় না বা পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে কঠোর বা অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে। বিচারকরা তখন তাদের শুভবুদ্ধি, সচেতন বিচারবুদ্ধিমাফিক সেই আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন কিংবা নতুন আইন তৈরি করেন। বিচারকের ন্যায়বােধ থেকে এভাবে অনেক নতুন আইন প্রণীত হয়েছে।
৬. আইন পরিষদঃ আধুনিককালে আইনের প্রধানতম উৎস হচ্ছে আইন পরিষদ আইনসভা জনমতের সাথে সঙ্গতি রেখে আইন প্রণয়ন করে। আধুনিক রাষ্ট্রীয় আইনের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইন। আইন পরিষদ শুধু নতুন আইন তৈরি করে না, পুরনাে আইন সংশােধন করে তা যুগােপযােগী করে তােলে।
স্বাধীনতা
স্বাধীনতা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Liberty। Liberty শব্দটি ল্যাটিন ‘Liber’ থেকে এসেছে। যার অর্থ স্বাধীন। সুতরাং শাব্দিক অর্থে মানুষের ইচ্ছানুযায়ী কিছু করা বা বলার ক্ষমতাকে স্বাধীনতা বলা হয়। সাধারণ ভাষায় স্বাধীনতা বলতে মানুষের ইচ্ছামত কোনাে কিছু করা বা না করার অধিকারকে বােঝায়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে অধীনতামুক্ত অবস্থাই স্বাধীনতা। লেখক ও চিন্তাবিদগণ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
জল স্টুয়ার্ট মিল তার ‘Essay on Liberty’ গ্রন্থে বলেছেন, “মানুষের মৌলিক শক্তির বলিষ্ঠ, অব্যাহত ও বিভিন্নমুখী প্রকাশই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার অর্থ মানুষ কর্তৃক নিজস্ব উপায়ে কল্যাণ অনুধাবন করা।
” হার্বাট স্পেনসার বলেন, “স্বাধীনতা বলতে খুশিমত কাজ করাকে বােঝায়, যদি উক্ত কাজ দ্বারা অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতা উপভােগে বাধার সৃষ্টি না ।
নিম্নে স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ তুলে ধরা হলােঃ
১. ব্যক্তি বা পৌর স্বাধীনতা
২.প্রাকৃতিক স্বাধীনতা
৩. আইনগত স্বাধীনতা
৪. সামাজিক স্বাধীনতা
৫. রাজনৈতিক স্বাধীনতা
৬. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
৭. জাতীয় স্বাধীনতা।
সাম্যের ধারনা
সাম্য অর্থ সমান। সাম্য বলতে বােঝায় সব মানুষ সামন । গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নীতিগতভাবে স্বীকার করা হয় যে, সকল মানুষই সমান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সব মানুষ এক সমান নয়। শারীরিক ও মানসিক গঠন এবং ক্ষমতা ও যােগ্যতার দিক থেকে একজনের সাথে অন্যজনের পার্থক্য রয়েছে। এজন্যই রাষ্ট্রের কাছ থেকে সকলেই সমান ব্যবহার দাবি করতে পারে না। একজন ডাক্তার ও একজন ঠিকাদার সমাজের কাছ থেকে সমপরিমাণ মর্যাদা ও স্বীকৃতি দাবি করতে পারে না।
পৌরনীতিতে সাম্য কথাটির বিশেষ অর্থ রয়েছে। পৌরনীতিতে সাম্যের অর্থ হচ্ছে সুযােগ-সুবিধার সমতা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে সমান সুযােগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থাকে সাম্য বলে।
অধ্যাপক লাস্কি বলেন, “সাম্যের অর্থ হলাে প্রথমত সব ধরনের বিশেষ সুযােগ-সুবিধার অনুপস্থিতি এবং দ্বিতীয়ত সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযােগসুবিধা উন্মুক্ত রাখা। তার মতে, সাম্যের তিনটি বিশেষ দিক রয়েছে।
যথাঃ
(১) বিশেষ সুযােগ-সুবিধার অনুপস্থিতি
(২) পর্যাপ্ত সুযােগ-সুবিধা সৃষ্টি এবং
(৩) বেঁচে থাকার জন্য প্রয়ােজনীয় বিষয়, সম্পদ ও দ্রব্যাদি জতি, ধর্ম , বর্ণ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমভাবে বণ্টন।
সুতরাং সাম্য বলতে মানবজীবনের সেই পরিবেশ বা প্রক্রিয়াকেই বােঝায়, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান সুযােগ-সুবিধা প্রদান করা হয়, সুষম পরিবেশ গড়ে তােলা হয় এবং সকলকে সমানভাবে আত্মবিকাশের সুযােগ প্রদান করা হয়।
সাম্যের বিভিন্ন রূপ বা শ্রেণিবিভাগ
সাম্য একটি অখণ্ড ধারণা। সাম্যের কোনাে প্রকারভেদ হয় না। যেমন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যান্য সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের সুযােগের জন্য সাম্যকে নিম্নলিখিত ৬টি উপায়ে শ্রেণিবিভাগ করা হলােঃ
১.স্বাভাবিক সাম্য
২. সামাজিক সাম্য
৩. রাজনৈতিক সাম্য
৪. অর্থনৈতিক সাম্য
৫. আইনগত সাম্য।
৬. ব্যক্তিগত সাম্য
আইন, স্বাধীনতা ও সাম্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ও গুরুত্বঃ
আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক সংক্রান্ত পরস্পর বিরােধী দুটি মতবাদ প্রচলিত রযেছে। কেউ মনে করেন, আইন ও স্বাধীনতা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং স্বাধীনতা আইনের ওপর নির্ভরশীল। এরিস্টটল, মন্টেস্কু, রিচি, উইলােবিবার্কার, লক প্রমুখ মনীষী এই মতের সমর্থক। বার্কারের ভাষায়, ‘স্বাধীনতা ও আইনের বিরােধ নেই।
আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরােধী। জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বাট স্পেনসার, এ. ভি. ডাইসি, গডউইন প্রমুখ মনীষী এই দলের সমর্থক। ডাইসির মতে, “একটি বেশি হলে, অপরটি কমে যায়।”
আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উভয় মতবাদেই অযৌক্তিক অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত, অবাধ স্বাধীনতা একদিকে যেমন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর তেমনি সকল আইন স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে না। গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরােধী নয়, বরং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
উভয় যুক্তির সম্পর্ক নিম্নরূপ
১. আইন স্বাধীনতার শর্ত ও ভিত্তিঃ আইন স্বাধীনতাকে সহজলভ্য করে তােলে। আইনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যথার্থভাবে স্বাধীনতা ভােগ করা যায় না। আইনের অবর্তমানে সবলের অত্যাচারে দুর্বলের অধিকার বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। আইন না থাকলে সমাজজীবনে ভয়াবহ অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলতার রাজত্ব শুরু হয়। উইলােবি বলেছেন, “নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই স্বাধীনতা রক্ষা পায়”।
২. আইন স্বাধীনতার রক্ষাকবচঃ আইন আছে বলে স্বাধীনতা ভােগ করা_ যায়। আইনের কর্তৃত্ব আছে বলেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধ থাকার কারণে সরকার বা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষ জনগণের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না। স্বাধীনতা লঙ্ঘন ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতে সাংবিধানিক ও সাধারণ আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা চলে। এ জন্যই লক বলেছেন যে, “যেখানে আইন থাকে না সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে ।
৩. আইন স্বাধীনতার অভিভাবকঃ আইন শাসকগােষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করে। আইন সংযত ও নিদিষ্ট সীমারেখার গণ্ডিতে সকলকে আবদ্ধ রেখে স্বাধীনতা বজায় রাখে। আইন আছে বলেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমাজ বিরােধী কার্যকলাপের ফলে স্বাধীনতা-বিঘ্নিত হয় না।
৪. আইন স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রসারিত করে : আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরিধি সম্প্রসারিত হয়। রাষ্ট্র আইনের দ্বারা এমন এক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে সুন্দর, সভ্য জীবনযাপনের অনুকূল অবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আইন ও স্বাধীনতার এরুপ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ করেই রিচি বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে যদি আত্মবিকাশের জন্য প্রযােজনীয় সুযােগ-সুবিধা বােঝায় তা হলে তা নিশ্চিতভাবেই আইনের দ্বারা সৃষ্টি হয়।
স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমানঃ
আইন সাম্যকে অর্থবহ করে তােলে। রাষ্ট্র আইন প্রয়ােগ করে অসাম্যকে দূর করতে পারে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে যুগে যুগে অনেক আইন সহায়তা করছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আইন করে বর্ণভেদ প্রথা দূর করা হয়েছে এবং পৃথিবীর অনেক দেশেই আইন করে সকল প্রকার অসাম্য দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনাে হচ্ছে। সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সাম্য নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীনতার প্রয়ােজন। স্বাধীনতার শর্ত পূরণ না হলে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। আবার স্বাধীনতাকে ভােগ করতে চাইলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা না হলে দুর্বলের সাম্য সবলের সুবিধায় পরিণত হবে। সাম্য ও স্বাধীনতা একই সাথে বিরাজ না করলে গণতান্ত্রিক অধিকার ভােগ করার প্রশ্নই ওঠে না। সাম্য উচু নীচুর। ভেদাভেদ দূর করে, আর স্বাধীনতা সমাজের সুযােগ সুবিধাগুলাে ভােগ করার অধিকার দান করে।
আর. এইচ. টনি- এর মতে “স্বাধীনতা বলতে যদি মানবতার নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ বােঝায়, তাহলে সেই স্বাধীনভা সাম্যভিত্তিক সমাজেই শুধু সম্ভব”। এজন্যই অধ্যাপক গােলার্ড বলেছেন যে, “স্বাধীনতার সমস্যার একটিমাত্র সমাধান রয়েছে। তা সাম্যের মাঝেই নিহিত।”
সুতরাং বলা যায় যে, স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। স্বাধীনতা ও সাম্য একই সাথে বৃহত্তর পরিসরে ব্যক্তি ও সমাজজীবনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে সাম্য থাকতে হবে। সাম্য থাকলে ব্যক্তি তথা সমাজ জীবন পূর্ণর্তা প্রাপ্ত হয় না। স্বাধীনতা ও সাম্য বৃহত্তর পরিসরে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এজন্যই বলা হয় যে, স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে রয়েছে একটি দ্বি-মাত্রিক সম্পর্ক।