গৌতম বুদ্ধের পরিচিতি
খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে সিদ্ধার্থ গৌতম কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল রাজা শুদ্ধোদন এবং মাতার নাম ছিল রানি মহামায়া। সিদ্ধার্থের জন্মের সাত দিন পর মাতা রানি মহামায়া মৃত্যুবরণ করেন। তারপর সিদ্ধার্থের লালন-পালনের দায়িত্ব নেন রানি মহাপ্রজাপতি গৌতমী। তিনি রানি মহামায়ার বোন ছিলেন।বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী করুন্তৃক লালিত-পালিত হয়েছিলেন বলে সিদ্ধার্থের অন্য নাম হয় গৌতম। শাক্যরাজ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তিনি শাক্যসিংহ নামেও পরিচিত।
[Tapos]সিদ্ধার্থের জন্মের খবর শুনে অনেক জ্যোতিষী রাজপ্রাসাদে আগম করেন। তাঁরা শিশু সিদ্ধার্থের মধ্যে বত্রিশটি সুলক্ষণ দেখতে পান এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘এই রাজকুমার গৃহে থাকলে রাজচক্রবর্তী রাজা হবেন, সন্ন্যাস জীবন ধারণ করলে মহাজ্ঞানী বুদ্ধ হবেন।’কিন্তু একমাত্র ঋষি অসিত বলেন, রাজকুমার মহাজ্ঞানী বুদ্ধ হবেন।
রানি মহাপ্রজাপতি গৌতমী এবং রাজা শুদ্ধোদনের অপরিসীম স্নেহ-মমতায় সিদ্ধার্থ ক্রমে বড় হয়ে উঠতে থাকেন। রাজা রাজকুমারের শিক্ষার জন্য বহু শাস্ত্রবিদ পন্ডিত নিয়োগ করেন। তিনি এঁদের নিকট নানা লিপিবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করেন।ক্রমে তিনি ঘোড়ায় চড়া, রথচালনা, অসি-চালনা যুদ্ধকৌশল এবং অন্যান্য বিদ্যা শেখেন। রাজকুমারের বুদ্ধি, মেধা ও স্মৃতিশক্তি দেখে গুরু বিস্মিত হন। অল্পদিনের মধ্যে রাজকুমার সকল শাস্ত্র ও শিল্পকলায় পারদর্শিতা লাভ করেন। রাজকীয় পরিবেশে রাজকুমার ক্রমে কৈশোরে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু কৈশোর বয়স থেকেই রাজকীয় ভোগ-বিলাসে তিনি উদাসীন ছিলেন। প্রায়ই তাঁকে একাকী নির্জনে ধ্যানমগ্ন থাকতে দেখা যেত। রাজকুমারের ভোগ-বিলাসের প্রতি উদাসীনতা দেখে রাজা শুদ্ধোদন চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করে অস্বস্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। ক্রমে রাজকুমার সিদ্ধার্থ যৌবনে পদার্পণ করেন। কিন্তু রাজা লক্ষ্য করলেন, যতই দিন যাচ্ছে কুমার ততই উদাসীন হয়ে যাচ্ছেন। তিনি রাজকুমারকে ভোগ-বিলাসে নিমজ্জিত রাখার জন্য সকল প্রকার আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করলেন।
কিন্তু কোনো কিছুই রাজকুমারকে আকৃষ্ট করতে পারল না। অবশেষে রাজা অমাত্যদের(মন্ত্রী) সঙ্গে পরামর্শ” পরামর্শ করেন। অমাত্যগণ রাজকুমারকে সংসারমুখী করার জন্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার পরামর্শ” পরামর্শ দেন। সপ্তাহব্যাপী জাকজমকপূর্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে যশোধরার সঙ্গে সিদ্ধার্থ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যশোধরা গোপাদেবী নামেও পরিচিত ছিলেন।
বাল্যকাল হতে সিদ্ধার্থের মনে যে বৈরাগ্যের সঞ্চার হয়, যৌবনে এসে তা আরো বৃদ্ধি পায়। রাজ-অন্তঃপুরের ভোগ-বিলাসের মধ্যেও সিদ্ধার্থের মনে শান্তি ছিল না। একদা তাঁর নগরভ্রমণের বাসনা হলো। রাজা ঘোষণা করে দিলেন, রাজকুমার নগরভ্রমণে যাবেন, পথ-ঘাট সব যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। নির্দেশ দিলেন, কোনো অসুন্দর দৃশ্য যেন রাজকুমারের দৃষ্টির মধ্যে না পড়ে। রাজার আদেশে রাজপথ পরিচ্ছন্ন ও সজ্জিত করা হলো। রাজকুমার নগরভ্রমণে বের হলেন। সাজসজ্জা দেখে রাজকুমারের প্রথম মনে হলো জগতে দুঃখ, বেদনা, হতাশা নেই। কিছুদুর যাওয়ার পর রাজকুমার দেখলেন, এক জরাজীর্ণ দুর্বল বৃদ্ধ বক্রদেহে লাঠিতে ভর দিয়ে অতিকষ্টে পথ চলছে। সিদ্ধার্থ রথচালক ছন্দককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও কে?’ ছন্দক বললেন, ‘এক বৃদ্ধ’। সিদ্ধার্থ বললেন, ‘সকলেই কি বৃদ্ধ হবে, আমরাও?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘সকলেই বৃদ্ধ হবে। এটাই জগতের নিয়ম।’ ছন্দকের কথা শুনে বিষন্ন মনে সিদ্ধার্থ রাজপ্রাসাদে ফিরে যান।
[Tapos]পরদিন আবার নগরভ্রমণে বের হন। দ্বিতীয় দিন দেখতে পেলেন, ব্যাধিগ্রস্ত এক লোক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সিদ্ধার্থ ছন্দকের নিকট কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই লোক ব্যাধিগ্রস্ত, সংসারের যে কেউ যে কোনো সময় এ রকম রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। সিদ্ধার্থ বিষন্ন মনে রাজপ্রাসাদে ফিরে যান।
তৃতীয় দিন সিদ্ধার্থ আবার নগরভ্রমণে বের হলেন। দেখলেন চারজন লোক একটি মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। পিছনে একদল লোক ক্রন্দন ও বিলাপ করুনছিল। কারণ জিজ্ঞাসা করলে ছন্দক বলেন, “জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যুবরণ করতে হয়। সকলেই মৃত্যুর অধীন। জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু মানুষের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।” সিদ্ধার্থ বিষন্ন মনে পুনরায় রাজপ্রাসাদে ফিরে যান।
চতুর্থ দিন রাজকুমার পুনরায় নগর ভ্রমণে বের হলেন। দেখলেন শান্ত, সৌম্য, গেরুয়া বসনধারী মুন্ডিত মস্তক এক সন্ন্যাসী ধীরগতিতে পথ চলেছেন। পরিচয় জানতে চাইলে ছন্দক বলেন, ‘ইনি সংসার ত্যাগী বন্ধনহীন এক মুক্ত পুরুষ। ভোগ-বিলাস বিসর্জন দিয়ে শান্তি অন্বেষণ করেছেন।’ ছন্দকের কথা শুনে সিদ্ধার্থ খুশি হন এবং গৃহত্যাগের সংকল্প করে রাজপ্রাসাদে ফিরে যান।
সিদ্ধার্থ যখন সংসার ত্যাগের চিন্তায় অস্থির, তখন খবর এল তাঁর এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। খবর শুনে তিনি বিচলিত হয়ে বললেন, ‘রাহু জন্মেছে, বন্ধন জন্মেছে।’ তাই পুত্রের নাম রাখা হলো রাহুল। পুত্রের জন্মসংবাদ শুনে সিদ্ধার্থ দৃঢ় সংকল্প করলেন, “আমি আর কালবিলম্ব না করে সকল বন্ধন ছিন্ন করে শীঘ্রই বেরিয়ে পড়ব।”
ক্রমে সিদ্ধার্থ ২৯ বছর বয়সে উপনীত হন। সেদিন ছিল আষাঢ়ী পূর্ণিমা।রাজ-অন্তঃপুরের সবাই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সিদ্ধার্থ বিদায়কালে গোপাদেবী ও প্রাণপ্রিয় পুত্রকে শেষবারের মতো দেখার জন্য গোপার কক্ষে প্রবেশ করলেন। দেখলেন, গোপা শিশুপুত্রকে বুকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রামগ্ন। একবার ইচ্ছা হলো শিশুটিকে কোলে নিয়ে আদর করবেন। পরক্ষণে ভাবলেন, কোলে তুলে নিলে মা জেগে উঠবেন, তাহলে তাঁর যাওয়াই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আত্মসংবরণ করে তিনি গোপার কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন।
অতঃপর রথচালক ছন্দককে নিদের্শ দিলেন অশ্ব কণ্থককে প্রস্তুত করে নিয়ে আসতে। ছন্দক কণ্থককে নিয়ে এলে উভয়ে অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে গৃহত্যাগ করেন। বৌদ্ধ পরিভাষায় সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগকে ‘মহাবিনিষ্ক্রমণ’ বলা হয়। অনোমা নদী পার হয়ে সিদ্ধার্থ ছন্দককে বললেন, “তুমি কণ্থককে নিয়ে ফিরে যাও।” ছন্দক গৌতমকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর মন কষ্টে ব্যথিত হয়ে উঠল। প্রিয় অশ্ব কণ্থক শোকে সেখানেই মৃত্যুবরণ করুনল। সিদ্ধার্থ পায়ে হেঁটে বৈশালী নগরে পৌঁছলেন। ঋষি আরাড় কালাম, রামপুত্র রুদ্রকের কাছে ধ্যান, যোগ ইত্যাদি শিক্ষা গ্রহন করলেন। তাতে তাঁর মন তৃপ্ত হলো না। সেখান থেকে গেলেন রাজগৃহে। রাজগৃহ থেকে উরুবেলার সেনানী গ্রামে। গ্রামটি নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। এখানে অশ্বত্থ গাছের নিচে শুরু করেন কঠোর ধ্যান-সাধনা। ছয় বছর কাটল তাঁর ধ্যান-সাধনায়।অবশেষে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে লাভ করেন বুদ্ধত্ব, জগতে তিনি খ্যাত হন বুদ্ধ নামে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ বছর।
বুদ্ধত্ব লাভের পর তিনি সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নিকট প্রথম ধর্মপ্রচার করেন, যেটি ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র নামে অভিহিত। সকল প্রাণীর দুঃখমুক্তি এবং মঙ্গলের জন্য তিনি সুদীর্ঘ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর তাঁর অমৃতময় ধর্মবাণী প্রচার করেন এবং আশি বছর বয়সে কুশিনারার শালবনে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।