0

ফরাসি বিপ্লব পূর্ববর্তী সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থার সাথে বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সের তুলনা। এইচএসসি ইতিহাস ৯ম সপ্তাহের এসাইনমেন্ট ২০২২ সমাধান।

HSC History 9th Week Assignment 2022

অ্যাসাইনমেন্ট: ফরাসি বিপ্লব পূর্ববর্তী সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থার সাথে বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সের তুলনা।

এইচএসসি ইতিহাস ৯ম সপ্তাহের এসাইনমেন্ট ২০২২ উত্তর

newresultbd.com

প্রাক বিপ্লব ফ্রান্সের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা:

সামাজিক অবস্থা:

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে প্রায় প্রতিটি দেশের সামাজিক অবস্থা ছিলো দুর্বিসহ। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পাশাপাশি তাদের দোসর শোষক শ্রেণি মানুষের উপর নানাভাবে চড়াও হয়। সাধারণ মানুষ যারা সামাজিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি তাদের জীবন ধারণই অনেক কঠিন হয়ে গেছিলো। ফ্রান্স থেকে শুরু করে অস্ট্রিয়া, ব্রান্ডেনবার্গ, স্পেন, ইংল্যান্ড কিংবা তথাকথিত পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য সবখানেই মানুষের কোনো অবস্থানগত মর্যাদা ছিলোনা বললেই চলে। স্বৈরশাসক ও তাদের দোসদের ছোবলে মানুষ পরিণত হয়েছিলো রাষ্ট্রযন্ত্রের একান্ত বাধ্যগত ভৃত্যে। সামাজিক আচার অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ সামাজিক সাম্যবস্থা নষ্ট করে বিশেষ শ্রেণির প্রাধান্য ও নিপীড়ন স্পষ্ট হয়েছিলো। তবে ফ্রান্সে সামাজিক অবস্থা সবচেয়ে সংকটময় ছিল। 

অর্থনৈতিক অবস্থা:

দাসশ্রম ভিত্তিক ইউরোপের অর্থনীতি এই সময় টিকে ছিলো মূলত নানা স্থানে বিস্তৃত উপনিবেশ থেকে সীমাহীন লুটতরাজ ও সম্পদ আহরণের মধ্য দিয়ে। রাজনেতিক বিশৃঙ্খলা আর ক্রমাগত যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান হয়েছিলো নিম্নমুখী। অর্থসম্পদ একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। মানুষের জীবনের নেই নিরাপত্তা, রাষ্টযন্ত্রের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে অনেকে দেশান্তরী পর্যন্ত হয়েছিলো। অর্থনৈতিক সংকটে জীবন বাঁচানোর দায় যেখানে বড় সেখানে নানা উৎসব আয়োজনের ছুঁতো করে পোপ গণমানুষের কাছ থেকে লুঠ করে নিজের ভান্ডার শক্তিশালী করছে।

এভাবে একটি দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিষ্পেষিত ছিলো সাধারণ মানুষ। ক্ষমতার দিক থেকে অনেকটাই ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র বলা যায় ফ্রান্সকে।

রাজনৈতিক অবস্থা:

কাগজে কলমে ইউরোপের নানা স্থানে জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান হলেও বাস্তবতায় সেখানে শক্তিশালী রাজতন্ত্র বিরাজ করছিলো। দুর্নিবার একনায়কতান্ত্রিক শাসনে ভূ-লুন্ঠিত হয়েছিলো মানবাধিকার। এখানে ব্যক্তি কিংবা রাজ্যের প্রতিটিপ্রতিষ্ঠানকে মনে করা হতো রাজতন্ত্রের সম্পত্তি। এখানে ব্যক্তির সাথে রাজ্যের আচরণ ছিলো যাচ্ছেতাই। মানুষের কল্যাণের জন্য সরকার ও রাষ্ট্র এই ধারণার কোনো অস্তিত্ব সেখানে ছিলো না। বলতে গেলে ক্যালেন্ডারের পাতায় আধুনিকযুগে পদার্পনের চিহ্ন দেয়া থাকলেও তখনকার ইউরোপের মধ্যযুগীয় বর্বর রাজতন্ত্রই নতুন করে জেঁকে বসে। ব্রান্ডেনবার্গ, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, নেদারল্যান্ড, রাশিয়া, স্পেন প্রভৃতি অঞ্চলে এই ধরণের শাসনকাঠামোর অস্তিত্বপরিলক্ষিত হলেও ফ্রান্সের অবস্থা ছিলো সবথেকে ভয়াবহ। তাই বিপ্লবীদের প্রতিরোধে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ফরাসি ভুখন্ড।

বিপ্লবের ফলাফল:

  1. সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ: ফরাসি বিপ্লবের মূল আদর্শ ছিল— সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। ফ্রান্সের গণ্ডি ছাড়িয়ে কালক্রমে এই আদর্শ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
  2. জাতীয়তাবাদের আদর্শ: ফরাসি বিপ্লবে যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে প্রভাবিত করেছিল। এই আদর্শের অনুপ্রেরণায় জার্মানি, ইটালি, গ্রিস প্রভৃতি দেশে জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
  3. প্রগতিশীল চিন্তার বিস্তার: ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা ও চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল। রুশো, ভলতেয়ার, মন্তেস্কু প্রমুখ ফরাসি দার্শনিকদের প্রগতিশীল চিন্তা সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত হয়।
  4. গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রসার: ফরাসি বিপ্লবের ফলে গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রসার ঘটেছিল। এই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে এবং গণতান্ত্রিক শাসন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক আদর্শগুলির দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব:

স্বাধীনতা,সাম্য মৈত্রীর আদর্শঃ ফরাসি বিপ্লবের মূল আদর্শ ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী (Liberty, Equality and Fraternity)ফরাসি জনগণের মনে এই আদর্শ এমনই বদ্ধমূল হয়ে ছিল যে, তারা পরবর্তী সকল কর্মে এই আদর্শকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করে ইউরোপের দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ও আন্দোলনের বিস্তার হতে থাকে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, প্রাশিয়া, সাইলেসিয়া, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় । ইতালি, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বেলজিয়াম, গ্রিস, বলকান প্রভৃতি অঞলে শুরু হয় জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রাম।

ফরাসি বিপ্লব বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থায় আঘাত হানে। যোগ্যতার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ।জন্মগত কৌলিন্য বাদ দিয়ে যোগ্যতা ও দক্ষতা মানুষের সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। দেশে দেশে এই ভাবধারা প্রচারিত হয়। ফরাসি বিপ্লব ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শ প্রচার করেছিল। কেবলমাত্র নিজ দেশবাসীকে নয় বিশ্ববাসীর সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দের বার্তা প্রচার করা হয়। তাই ফ্রান্স ইউরোপের অন্যান্য সহযোগী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল।

নতুন ফরাসি সংবিধানঃ ফরাসি বিপ্লব স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ওপর কুঠারাঘাত হানে। বংশানুক্রমিক ও স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসি রাজতন্ত্রের পরিবর্তে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সর্বস্তরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নাগরিকদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়ে যে, জনগণই ক্ষমতার উৎস। এছাড়া, এই সংবিধান-বলে ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব’-ও গুরুত্ব পায় এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে আইনসভা সার্বভৌম ক্ষমতার আধার বলে গণ্য হয়।

সামন্ততন্ত্রের বিলোপ: ফরাসি সমাজ ছিল ত্রিস্তর বিশিষ্ট। শ্রেণিবিভক্ত এই সমাজ ‘বিশেষ অধিকারভোগী’ ও ‘অধিকারহীন’— এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। অভিজাতরা নানা প্রকার সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষ অধিকার ভোগ করত;অথচ এদের কোন কর দিতে হতে হত না।অপরদিকে সবরকম সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল অন্যায়,অত্যাচার ও শোষণের শিকার। তাদের নানা ধরনের করভার বহন করতে হত ।১৭৯১-এর সংবিধান সভা সবরকম সামন্ত্ৰতান্ত্রিক অধিকারের বিলুপ্তি ঘটায়।ফ্রান্সের মাটিতেই সর্বপ্রথম সামন্তপ্রথার সমাধি রচিত হয় এবং কালক্রমে এই ভাবধারা ইউরোপের অন্যান্য দেশে সম্প্রসারিত হয়।

নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ঘোষণা: ফরাসি বিপ্লব কেন্দ্রীভূত স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সে জনগণের শাসনের সূচনা করে। এই বিপ্লব ঘোষণা করে যে, জনগণই হল সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। জনগণের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের ইচ্ছাই আইন— এই দুটি আদর্শের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপিত হয় এবং নাগরিকদের এই সব অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি জানায়।এককথায়, ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্স মধ্যযুগ থেকে আধুনিকতা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।